Wednesday, March 12, 2025
Homeশিক্ষামূলক গল্পগল্প: রাজা ও হরিণের প্রেম

গল্প: রাজা ও হরিণের প্রেম

গল্প: রাজা ও হরিণের প্রেম

এক রাজা একদিন বাঘ শিকারের জন্য গেলেন বনে। সারা দিন তিনি এক গাছের উপর মাচা পেতে তীর ধনুক নিয়ে বসে বাঘ শিকারের জন্য, দিন কেটে যায় বাঘের দেখা মেলে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ঠিক সূর্যটা যখন পশ্চিমে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তখন রাজা খেয়াল করলেন একটা সুন্দর হরিণ ছুটে পালাচ্ছে। হরিণটাকে খাওয়ার জন্য তাড়া করেছিল একটা বাঘ। রাজা এত সুন্দর একটা হরিণ দেখে যতটা না মুগ্ধ তার চাইতে বেশী রাগান্বিত হলেন ওই সুন্দর হরিণটাকে বাঘে খেতে যাচ্ছে তা দেখে।

রাজা তার ধনুকে তীর লাগিয়ে এক নিশানায় বাঘটিকে কুপোকাত করলেন। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য হরিণটি রাজার নিকট এসে কুর্ণিশ করে বলল, ‘মহারাজ আজ আপনি প্রমাণ করলেন আপনি শুধু মাত্র মানুষের রাজা নন, তাদের অভিভাবক নন, আমাদের মতো বনের অসহায় প্রাণীদেরও অভিভাবক, আমাদের রাজা। আপনার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ।’

রাজা হরিণটার সৌন্দর্য্য দেখে আরও মুগ্ধ হলেন। তারপর হরিণকে বললেন, ‘আমার রাজ্যে সকল মানবকুল যেমনটা স্বাধীন, ঠিক বনের সকল প্রাণীও আজ থেকে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলবে।’ রাজার এমন ঘোষণায় বনের সকল প্রাণী আনন্দে আন্দোলিত হল। রাজা রাজ প্রাসাদে ফিরে গেলেন। কিন্তু তার চোখে শুধুই ভাসছে ওই সুন্দর হরিণটা। পরদিন রাজা আবার বনে গেলেন হরিণটাকে খুঁজতে। হরিণের সঙ্গে দেখা পেয়ে রাজা তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন খোশগল্প। এভাবে রাজা প্রতিদিন বনে যেতেন ওই হরিণের সঙ্গে সঙ্গ দিতে। হরিণ ও তার জীবন বাঁচানো এবং রাজার এমন বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহারে মুগ্ধ। প্রতিদিনই হরিণ রাজার জন্য অপেক্ষা করত আর রাজা ব্যাকুল থাকতেন কখন তিনি হরিণটাকে দেখতে পাবেন।

একদিন রাজার মনে হল সে হরিণটার অভাব সব সময় অনুভব করছেন। রাজসভার কাজ যখন চলে তখন রাজার মনে হতো এখন যদি হরিণটা আমার পাশে থাকত। রাজা যখন বসার ঘরে যেতেন তখন ভাবতেন আহা হরিণটা আমার পাশে থাকলে কত না ভাল হতো! শোবার ঘরে যাওয়ার পর রাজার মনে হতো হরিণটা যদি আমার শোবার ঘরে এক কোণায় থাকত কত না ভাল হতো!

এর পর দিন রাজা বনে গেলেন। বিষয়গুলো বন্ধু হরিণকে খুলে বললেন। হরিণ রাজার এমন কথা শুনে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে লাগল। এবার রাজা হরিণেকে প্রস্তাব করল, ‘বন্ধু তুমি আমার সঙ্গে চলো আমার রাজ প্রাসাদে থাকবে। সব সময় আমার পাশে পাশে থাকবে।’ হরিণ উত্তরে বলল, ‘মহারাজ সেটা কী করে সম্ভব? আমি তো বনের হরিণ। বনে ছুটে বেড়ানো, বনের তৃণ-লতা খাওয়ায় আমার স্বভাব। এটাই আমার প্রকৃতি। আমি তো ওই মার্বেলের রাজপ্রাসাদে আপনার মনের হরিণ হয়ে থাকতে পারব না।’

কিন্তু রাজা মানতে নারাজ। সে হরিণকে অনুরোধ করেই চললেন। এবার হরিণ রাজার এমন প্রেম দেখে বলল, ‘মহারাজ উপায় একটা আছে। আপনি আগামীকাল একটা কাঠের তৈরী হরিণ নিয়ে আসেন। আমি উপায় বের করে দিব।’

রাজা চলে গেলেন রাজপ্রাসাদে। পরদিন কাঠমিস্ত্রিদের ডেকে বললেন, ‘আমাকে কাঠ দিয়ে একটা সুন্দর হরিণ বানিয়ে দাও।’ রাজার আদেশ মতো কাঠমিস্ত্রিরা একটা সুন্দর কাঠের হরিণ বানিয়ে দিল। রাজা এবার ওই কাঠের হরিণ নিয়ে বনে হাজির। এবার সে তার বন্ধু হরিণকে বললেন, ‘বন্ধু এই নাও কাঠের হরিণ। এখন বলো কী উপায়ে আমি তোমাকে আমার সঙ্গে সব সময় পাব?’ তখন বনের হরিণ তার নিজের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে রাজার ওই কাঠের হরিণের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘মহারাজ দেখেন ঠিক আমার মতো হয়েছে না? এখন আপনি একে আপনার কাছে কাছে রাখতে পারবেন।’ রাজা চামড়া জড়ানো কাঠের হরিণ দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি খুশী মনে ওই কাঠের হরিণ নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরলেন।

রাজার প্রতি ভালবাসা ও তার প্রাণ বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজের গায়ে চামড়া খুলে দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল বনের হরিণটা। অন্যদিকে রাজা কাঠের হরিণটা নিয়ে কখনো রাজ দরবারে, কখনো বসার ঘরে, কখনো শোবার ঘরে নিয়ে রাখেন। এখন আর রাজা ওই হরিণের অভাব অনুভব করেন না। এভাবে কিছু দিন গেল। রাজা মনের আনন্দে কাঠের হরিণকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে বিচরণ করেন। এখন আর রাজা নিয়মিত বনে যান না।

একদিন রাজা শোবার ঘরে শুয়ে শুয়ে কাঠের হরিণটাকে বলছেন, ‘বন্ধু দেখেছ, আগে ক্ষণিকের জন্য তোমার সঙ্গে আমার দেখা হতো। এখন সব সময় তুমি আমার পাশে। এ জন্য তোমার আনন্দ লাগে না?’ রাজার এমন কথা কাঠের হরিণ নিশ্চুপ। রাজা আবারও মনের অজান্তে কথাগুলো কাঠের হরিণকে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু এবারও কোনো উত্তর এলো না। ঠিক তখনই রাজার মনে পড়ল এটা তো নির্জীব কাঠের হরিণ ও কথা বলবে কী করে?

এভাবে আরও কিছু দিন গেল। প্রায় রাজা একটি ভুল করছেন, কাঠের হরিণের সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু হরিণ তো নিশ্চুপ। কিছু দিন পর রাজা বললেন, ‘বন্ধু আগে তুমি কত সুন্দর দৌড়াতে, আমি বনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তুমি দৌড়ে আমার কাছে চলে আসতে। এখন তুমি সেটা করো না কেন?’ রাজার মনে হল কাঠের হরিণটা মনে হয় এই মার্বেলের রাজপ্রাসাদে দৌড়াই না। তখন রাজা প্রাসাদের সামনের বাগানে নিয়ে গেলেন হরিণটাকে।

কিন্তু ফলাফল, এবারও রাজা হতাশ। রাজা কাঠের হরিণটাকে নিয়ে এবার ফিরে গেলেন সেই বনে যেখানে হরিণের সঙ্গে রাজার প্রেম হয়েছিল। জঙ্গলে গিয়ে রাজা কাঠের হরিণটাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘বন্ধু এই নিসর্গ পরিবেশই তোমার জন্য উত্তম, তুমি এখন মনের আনন্দে ছুটতে থাকো আমি প্রাণ ভরে দেখব।’ রাজার এমন আহ্বানেও সাড়া দিল না কাঠের হরিণ।

এবার রাজা বনের অন্য সব প্রাণীদের জিজ্ঞেস করলেন তার বন্ধু হরিণের কথা। সবাই রাজাকে বলল, আপনাকে খুশী করতে নিজের গায়ের চামড়া খুলে দিয়ে হরিণটা মরে গেছে। তার আর দেখা পাওয়া যাবে না।

রাজা প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করলেন। এবার কাঠের হরিণের মুখে বুলি ফুটল, কাঠের হরিণ বলল, ‘বন্ধু তুমি কাতর কেন? তুমি তো চেয়েছ আমি তোমার পাশে-পাশে থাকি। আমি তো তাই নিজের গায়ের চামড়া তোমাকে খুলে দিয়েছি।’ রাজা বললেন, ‘বন্ধু, আমি তো তোমার দুরন্ত ছুটে চলা দেখতে চাই। আমি তো দেখতে চাই আমার বন্ধু বনের লতা-পাতার সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু আমার রাজপ্রাসাদে তো বনের এমন মনোরম পরিবেশ নাই।’

এবার কাঠের হরিণ বলল, ‘বন্ধু আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমার স্বভাব আমার প্রকৃতি হল বন্য। আমাকে ওই চার দেয়ালের মার্বেল প্রাসাদে মানায় না। তাই তো তোমাকে আমি আমার খোলসটা দিয়ে প্রাণ বিসর্জন করেছি। এখন আর বন্ধু ফিরে আসা সম্ভব নয়। তুমি এই কাঠের হরিণকে নিয়েই সুখী হও। হয় তোমাকে এই কাঠের হরিণ নিয়েই সুখী হতে হবে; না হয় এই কাঠের হরিণকে ছুড়ে ফেলতে হবে।’

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments