পটলার শিকারি মামা – শক্তিপদ রাজগুরু
পটলা কয়েকদিনের জন্যে এসেছে তার মামাদের আয়রন ওর মাইনস-এ। সারন্দার বন-পাহাড়ের দেশ, চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সেই পাহাড়গুলো ঘন শাল, মহুয়া, সেগুন, পিয়াশাল ইত্যাদি বড়ো-বড়ো গাছের বিস্তীর্ণ দুর্গম অরণ্যে ঘেরা। এসব অঞ্চলে বুনোহাতি, হরিণ, গন্ডার, ভল্লুক এমনকী, ডোরাকাটা রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ, চিতা, বাইসন, কী নেই।
বনের মাঝে-মাঝে আদিবাসীদের বসতি, তারা বাঘ, হাতি, বাইসনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। প্রায়ই তাদের লড়াই হয়, সেই লড়াইয়ে মাঝেমধ্যে মানুষও মারা যায়। এখানকার আদিবাসীরা বনের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে থাকে, তাদের একজন করে সর্দারও থাকে।
পটলার ছোটোমামা এরকম ভয়ানক জায়গায় থাকেন! তিনি নাকি বিরাট শিকারি। তবে তার ছোটোমামা ঠিক কী মেরেছেন, তা অবশ্য পটলা জানে না। তবে ছোটোমামা মুখে রোজই দু-চারটে বাঘ, হাতি, বাইসন মারছেনই।
পটলার মামা সকলের ছোটো হলেও তাঁর চেহারটা মোটেও ছোটো নয়। তাঁর শরীরটা হাতির মতোই নধর, মাথাটা তাঁর শরীরের তুলনায় ছোটো আর মাথার উপর চুল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। বেশ তেল চুকচুকে বেলের মতো মাথা জুড়ে টাক বিরাজ করছে। সকলে বলে, অতিরিক্ত ভোজনের ফলেই শরীরের গরমে চুলগুলো নাকি চৈত্রের ঝরা পাতার মতো সব ঝরে গিয়েছে।
ওঁর গোলগাল চেহারা আর ফুলসাইজের তারকেশ্বরের কুমড়োর মতো ভুঁড়ির জন্যে ওঁকে ‘পমকিনমামা’ বলেই ডাকে এলাকার মানুষ।
চারদিকে পাহাড় আর গভীর জঙ্গলে ঘেরার এই এলাকাটা যেন চিররহস্যের অন্ধকারে ঢাকা। জিপ নিয়ে পটলা মামাবাবুর সঙ্গে বের হল। এই বনের মধ্যে দিয়ে যেতে পটলার গা ছমছম করছে। সন্ধে হলে বনে নামে আদিম অন্ধকার।
কখনও দেখা যায় হাতির পাল, কখনও ধাবমান বাইসন, শোনা যায় দূর থেকে ভেসে আসা বাঘের গর্জনও।
মামা বললেন, ‘ভয় নেই, আমি আছি না! আমার কাছে রাইফেল আছে।
এক গুলিতে কত বাঘ-হাতি মেরেছি জানিস? আমি থাকলে বাঘ-হাতি এদিকে আসার সাহস পাবে না। আমার উপর গুরুর আশীর্বাদ আছে কিনা!’
পটলার মামা আবার শখ করে বেশ পুরুষ্টু গোঁফও রেখেছেন।
মামা বললেন, ‘বাঘের গোঁফ আছে তা তো জানিস? অবশ্য ওটা ওর পার্সোনাল ব্যাপার, তাই আমিও গোঁফ রেখেছি। আমার একটা মানত আছে, পঞ্চাশটা বাঘ মারা পূর্ণ হলে তবেই আমি আমার গোঁফ ছাঁটব। তবে উনার পঞ্চাশটা বাঘ মারা হয়ে গিয়েছে, অ্যানাদার ওয়ান মারতে পারলে গুরুদেব ‘মারণমন্ত্র’ দেবেন বলেছেন। আর পঁচাত্তরটা হলে মহাগুরু দেবেন ‘শব্দভেদী মারণমন্ত্র’।
এসব গুরু-মহাগুরু, মারণাস্ত্র আর এত বাঘ মারার কথা শুনে এবার পটলাও বেশ ঘাবড়ে গেল। পটলা বলল, ‘বাকি একটা বাঘ আর মারা হবে না। সরকার এখন বাঘ মারতে দেবে না।’
পটলার মামা গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘দেবে, দেবে। এরা মানুষ খাবেই, আর ম্যানইটার বাঘ মারার হুকুম দেয় সরকার। জানিস, সেবার কী হয়েছে? সেবার বাঘটা ওদিকে ম্যানইটার হয়ে ঘুরছে। আর আমিও ঘুরছি তারই সন্ধানে।’
পটলা চমকে উঠল। বন এখানে বেশ গভীর, ওঁরা এই বনের মধ্যে দিয়েই চলেছেন। পটলা এদিক-ওদিক দেখছে। মামা বললেন, ‘মানুষখেকো বাঘও খুব চালাক হয়। এদের দেখলে মানুষের বোধবুদ্ধি সব লোপ পায়। ওরা ভূতেদের সঙ্গে চলাফেরা করে। তবে গুরু আমাকে এসব ট্যাকল করার মন্ত্র শিখিয়েছেন। আর মহাগুরু একবার যদি শব্দভেদী মারণাস্ত্রের মন্ত্রটা দিয়ে দেন, তা হলে আর বনে-বনে শিকারের সন্ধানে ঘুরতে হবে না। ঘরে থেকেই মন্ত্র পড়ে বাঘ মারা যাবে।’
পটলা বলল, ‘গুরু, মহাগুরুরা কীরকম?’
পটলা সিনেমায় দেখেছে, মিঠুন নাকি হাফপ্যান্টে গুরু আর ফুলপ্যান্টে মহাগুরু সংলাপটা বলেছিলেন। তাই পটলার কৌতূহলটা থেকে গেল।
পটলার মামা গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এটা সারন্দা ফরেস্ট। এটা গুরু, মহাগুরুর অঞ্চল। ঠিক আছে, তোকে নিয়ে যাব আমার গুরুর কাছে। দেখবি, কেমন এলেম ওঁদের!’
এখানে বন কিছুটা জমাট। কিছু আদিবাসীর ঘর রয়েছে। যদিও দু-চারটে গাড়ি চলছে। হঠাৎ কোথা থেকে আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন।
পটলা জিজ্ঞেস করল, ‘কী গো মামা? কীসের আওয়াজ?’
পটলার মামা এবার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললেন, ‘মনে হচ্ছে ম্যানইটার।’ তারপর বন্দুকটা নিয়ে বললেন, ‘শিওর ম্যানইটারের গন্ধ।’
পটলাও একটা বিশ্রী গন্ধ পেল।
ওদিকে ঝোপটা নড়ছে। পটলার মামা এবার তাঁর প্রমাণ সাইজের ভুড়ি নিয়ে থপথপে হাতির চালে বন্দুক উঁচিয়ে ঝোপের ওদিকে এগোচ্ছেন। কে জানে কী হয়? পটলাও তাই জিপের নীচে গিয়ে ঢুকল। পটলা লক্ষ করছে তার মামার পঞ্চাশতম বাঘ মারার প্ল্যান।
পটলার মামা এবার ঝোপ লক্ষ করে বন্দুকের ট্রিগার টিপলেন, তারপরেই গুলির শব্দ।
বাঘটা বোধ হয় গুলির ঘায়ে আহত হয়েছে। নিস্তব্ধ বনে গুলির শব্দে কত অজানা পাখির দল ভয়ে চিঁচিঁ করে উঠল। পটলা অপলক নয়নে ঝোপের দিকে লক্ষ রেখেছিল, কিন্তু কোথায় কী? কোথায় বাঘ? গুলির শব্দে বন থেকে বেরিয়ে এল একটা বড়ো শিংওয়ালা কালো রঙের রামপাঁঠা।
রামপাঁঠাটা বন থেকে বেরিয়ে সামনে পমকিনমামাকে দেখে শিং বাগিয়ে তেড়ে এল। মামা পালাতে গিয়ে পাঁঠাবাবাজির শিংয়ের গুঁতোয় ছিটকে পড়লেন। তারপরেই পাঁঠাটা গভীর বনে চলে গেল। পমকিনমামা এবার মাটির উপর ফুটবলের মতো খানিকটা গড়াগড়ি খেয়ে কোনোও মতে বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে উঠেই বনের উদ্দেশ্যে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ব্যাটা পাজি, অসভ্য পাঁঠা। আমাকে গুঁতোল বলে, না-হলে ওটাকে আজই খতম করে দিতাম।’
পটলা বলল, ‘তোমার এলেম আছে মামা।’
‘কেন?’ পটলার মামা জিজ্ঞেস করলেন।
পটলা বলল, ‘গুলি করে কেউ বড়ো ছাগল মেরেছে শোনা যায়নি। তুমিই প্রথম সেই শিকারি।’
মামা বললেন, ‘হুঁ! চল, আমার গুরু-মহাগুরুর কাছে। ওঁদের দেখলে বুঝবি তোর মামা কার শিষ্য।’
সব বিষয়েই গুরুর কাছে নাড়া বাঁধতে হয়। তাই পটলার মামারও গুরু আছেন।
পটলা গিয়েছে বনের ভিতর একটা আদিবাসী গ্রামে। কয়েকটা চালার বাড়ি। চারদিকে গাছগাছালি ঘেরা। একটা বড়ো গাছের নীচে ওদের প্রধান আদিবাসীর স্থান। পটলা দেখল, ওদিকের ঘরটায় কয়েকজন রয়েছেন, সঙ্গে আছেন এক বৃদ্ধ আদিবাসীও।
পটলার মামা ওঁকে প্রণাম করে একটা থালায় কিছু চাল, আলু, কলা এবং প্রণামিও দিলেন। ইনিই পটলার মামার গুরু।
পটলা মামার গুরুকে দেখছে। গুরু তখন দু-হাত তুলে বললেন, ‘তুই আয়। তোকে আমি পঞ্চাশটা টাইগার মারতে বলেছি। আমি জানি তুই পারবি। আর ভল্লুক মারবি বাহান্নটা।’
‘তাহলে মন্ত্র দেবেন তো? সেই শিকারি মন্ত্র, আমার বাঘমারা আর মাত্র একটা বাকি।’
গুরুকে প্রণাম করে বের হয়ে এলেন পমকিনমামা। পটলাও বেরিয়ে এসে বলল, ‘মামা, এই তোমার গুরু?’
মামা বললেন, ‘গুরুর মন্ত্রশক্তি তো জানিস না, ওঃ, এই মন্ত্রটা যদি পাই!’
পটলা বলল, ‘তা এই গুরুর মন্ত্রটা কীরকম?’
মামা বললেন, ‘আমার গুরু একবার মন্ত্র পড়ে দিলে বাঘ, হাতি, বাইসন যে যেখানে থাকুক না কেন মন্ত্রের জোরে তারা বসতি অঞ্চলের ধারেকাছে ঘেঁষার সাহস পাবে না। এবার চল আমার মহাগুরুর কাছে।’
‘তাঁর আবার কী এলেম?’ জিজ্ঞেস করল পটলা।
এবার পটলার মামা বললেন, ‘আমি কী করে বলব তাঁর শক্তি সম্পর্কে। গিয়েই দেখবি চল।’
পটলাকে ওর মামা নিয়ে এসেছেন অন্য একটা বনের মধ্যে। এখানে আর একরকম বসতি। জায়গাটা ছায়া অন্ধকারে ঘেরা। পাশে বেশ কয়েকটা পাথরে সিঁদুর মাখানো রয়েছে।
আশপাশে বেশ কয়েকটা মহুয়াগাছও রয়েছে। অনেক লোকজনও রয়েছে, আর পাথরের উপর বসে রয়েছেন মামার সেই মহাগুরু। তাঁর দশাসই চেহারা, বড়ো-বড়ো চুল। গায়ের রং কুচকুচে কালো। নানা বয়সি ভক্তের সমাগম হয়েছে। মহাগুরু যেন ধ্যানে মগ্ন!
একজন কিছু আনাজ আর টাকা দিয়ে প্রণাম করতে মহাগুরু চোখ খুললেন। লাল চোখ। ওদিকে ধামসা বেজে উঠল। ভক্তরা তাঁর জয়ধবনি দিয়ে উঠল। একটা চ্যালা ওঁর হাতে বন্দুক আর কিছু কার্তুজ এগিয়ে দিল। ওদিকে জনতার জয়ধবনি উঠল, ‘মারাংবুরু কী জয়!’
এবার জনতার মধ্যে কলরব উঠল, ‘আমাদেরটা বলব।’
একজন চিৎকার করে উঠল, ‘গুরুদেব, আমাদের শিয়রে বিপদ। আমাদের কথা আগে শুনুন।’
গুরুদেব এবার হাত তুলে আশ্বাস দিলেন, ‘এক-এক করে বলে যা।’
এবার একদল লোকের মধ্যে থেকে একজন মহাগুরুর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘আসানবনি বনে একটা হাতি রেগে গিয়ে বসতি ভাঙছে, মানুষ মারছে।’
মহাগুরু গর্জে উঠলেন, ‘আসানবনির হাতি!’
পটলা দেখল, মহাগুরু জায়গার নাম বলে চোখ বুজে কীসব মন্ত্র আউরে শূন্যে গুলি ছুড়লেন।
আর একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘এদেলবাঁও আদিবাসী অঞ্চলে একটা বাঘ দশজন মানুষ মেরেছে। ওটাকে…!’
মহাগুরু গর্জে উঠলেন বন্দুক তুলে, ‘এদেলবাঁও গ্রামে মানুষখেকো বাঘ!’
আবার গুলি বেরোল শূন্যে।
‘কলাবনিতে একটা বাইসন ঝামেলা করছে বাবা!’
মহাগুরু আবার গর্জে উঠলেন, ‘কলাবনির বাইসন…!’ আবার একটা গুলি বেরোল। এভাবে বেশ কয়েকটা গুলি চলল আর তার সঙ্গে জায়গার নাম করে মহাগুরুও গর্জে উঠলেন। ভক্তরা জয়ধবনি করল।
পমকিনমামা বললেন, ‘মহাগুরুজি যদি দয়া করেন! যদি ওই মন্ত্রটা…।’
মহাগুরু বললেন, ‘এখনও পঞ্চাশটা বাঘ মারা হয়নি। আগে মেরে আয়, তারপর চিন্তা করব।’
এবার মহাগুরু জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যা এখন, এবার শোরগোল বন্ধ কর, বাড়ি ফিরে যা সবাই।’
মামার সঙ্গে পটলা ফিরতে-ফিরতে জিজ্ঞেস করল, ‘এটাই তোমার মহাগুরু তো? গাছতলায় দাঁড়িয়ে দুমদাম করে কয়েকটা গুলি করলেন, ব্যাস!’
মামা বললেন, ‘এটাই তো ওঁর মহিমা। ওই যে এক-একটা বাঘ, হাতি, বাইসনের নাম করে গুলি ছুটল, ওই গুলি এতক্ষণে গিয়ে খুঁজে-খুঁজে সেইসব প্রাণীদের বুকে গিয়ে বিঁধছে, ওরা মারা যাচ্ছে। আমাকে এই মন্ত্রটাই শিখতে হবে, বুঝলি! তাহলে ঘরে বসে মন্ত্র পড়ে বন্দুক চালালেই এক গুলিতে বাঘ, হাতি খতম হয়ে যাবে, বনে-বনে আমাকে ঘুরতে হবে না। মন্ত্রটা আমাকে দেবেন বলেছেন, কিন্তু পঞ্চাশটা বাঘ মারতে যে এখনও একটা বাকি!’
পটলার মামা ওই উনপঞ্চাশের গাঁটে এসে আটকে আছেন।
সেদিন বাড়ি ফিরে ওঁরা শুনলেন, বনের একটা বাঘ কাছেই এক বাড়িতে বেশ কিছুদিন ধরে গোরু-বাছুর মেরে এবার মানুষ মারতে শুরু করেছে।
খবরটা মামার কানে এসে পৌঁছেছে। দু-একজন শিকারি ওটাকে ধরার চেষ্টাও করেছিল কিন্তু পারেনি। বাঘটা নাকি বনে ওঁত পেতে বসে আছে। তাই গ্রামের মানুষ এসেছে পমকিনমামার কাছে!
মামাও আর একটা বাঘ মারতে পারলেই মহাগুরুর সেই মারণমন্ত্র পাবেন! তাই মামা বললেন, ‘এই সুযোগ ছাড়তে আমি রাজি নই।’
পটলাও পমকিনমামার সঙ্গে জঙ্গলে এসে হাজির হল। গভীর বন, চারদিকে ছায়াসঙ্গী বড়ো-বড়ো গাছ। সামনে একটা নদী আছে। বাঘটা সেই নদী পার হয়েই বাড়িতে ঢুকে মানুষ মারে।
পমকিনমামা গ্রাম থেকে একটা প্রমাণ সাইজের খাটিয়া আনিয়েছেন। গ্রামের মানুষ সেই খাটিয়া দড়ি দিয়ে তুলেছে একটা বড়ো ঝাঁকড়া আমগাছের উপর। আমগাছের দুটো মজবুত ডালে দড়ি দিয়ে সেই খাটিয়া সেট করেছে।
খাটিয়ার উপর উঠেই বন্দুক চালিয়ে বাঘ মারবেন পটলার পমকিনমামা। কিন্তু মামার বিশাল শরীর, তাই মামা নিজেই বললেন, ‘আমগাছের ডাল তো পলকা, খাটিয়ার উপর উঠব না।’
গ্রামের মানুষ বলল, ‘পাকা ডাল, কোনো ভয় নেই।’
গ্রামের মানুষ মই আনল, তারপর ওরাই ধরাধরি করে কোনোরকমে মামাকে গাছের উপর খাটিয়ায় তুলে দিল। মামার উলটো দিকে বসল পটলা। সে দেখল, মামা বেশ সতর্কভাবে চোখ রাখছেন চারদিকে। সন্ধে নামল, গ্রামের মানুষ ভয়ে আর বনে থাকল না। পটলাও তার মামার পঞ্চাশতম বাঘ মারা দেখতে পাবে এই ভেবেই খুশি হল।
অন্ধকার নামল বনে। রহস্যময় রাত্রি, গোটা বনে যেন বিচিত্র শব্দ ভেসে আসছে। পটলার মামা বন্দুক বাগিয়ে বসে আছেন। হঠাৎ দেখা গেল, গভীর বনের ভিতর থেকে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ বের হয়ে এল। চারদিক নিস্তব্ধ। মামা বললেন, ‘বোধ হয় বাঘ, ওরে বাবা…!’
তারপরেই মামা নড়েচড়ে বসতে গেলেন, আর মামার বিশাল শরীরের ভারে আমগাছের ডালটা মড়মড় করে ভেঙেই গেল। খাটিয়া সমেত মামা তাঁর বিশাল শরীর নিয়ে হুড়মুড় করে পড়লেন নীচে।
সেই বাঘটাও ওই সময় কোনো গন্ধ পেয়ে আমগাছের নীচে এসেছিল। আর পড়বি তো পড় পমকনিমামার বিশাল শরীরটা এসে পড়ল বাঘের উপর, সঙ্গে খাটিয়া ও গাছের ডাল।
খাটিয়ার নীচে বাঘ আর উপরে মামা। বাঘবাবাজির দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এদিকে মামাবাবু গাছে থাকতেই জ্ঞান হারিয়েছেন ভয়ে। ফলে তাঁর বিশাল শরীর চেপে বসে আছে বাঘের উপর। আর বাঘটারও বয়স হয়েছে। তার নখ-দাঁত, শরীরের জোরও তেমন নেই। বন্যজন্তু শিকার বোধ হয় আর সে করতে পারে না, তাই লোকালয়ে ঢুকে মানুষ মারা শুরু করেছে।
এদিকে পটলা পড়েছে বিপদে, ওদিকে পমকিনমামার সাড়াশব্দ নেই। তাঁর খাটিয়ার নীচে বাঘটা তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। বেচারা অসহায় বাঘবাবাজি!
একা পটলা অন্ধকারে কী করবে জানে না। হঠাৎ গ্রামের মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওরা বোধ হয় এদিকেই আসছে। গ্রামের অনেকেই কী একটা বিকট শব্দ পেয়ে হাতে বল্লম, লাঠি, কুঠার, আলো নিয়ে সেই জায়গায় এসে দেখল, বাঘটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। গ্রামের মানুষ এই অবস্থায় বাঘটাকে জাল ফেলে বন্দি করে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে বাঘটার কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। এমনিতেই বাঘটার বয়স হয়েছে, তার উপর গলায় মামাসমেত খাটিয়ার ভারে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে।
সকাল হয়েছে। গ্রামের মানুষও খুশি। বাঘটাকে সামনে রেখে পমকিনমামা পটলাকে বললেন, ‘বেশ বড়ো করে একটা ফোটো বের করতে হবে বুঝলি, যেখানে গোল্ডেন জুবিলি বাঘ মারার ফোটো থাকবে।’
পটলা বলল, ‘মামাবাবু, লোকে গুলি করে বাঘ মারে, তবে কেউ যে স্রেফ বডির চাপে বাঘ পিষে মেরেছে, এমন নজিরবিহীন ঘটনা তুমিই প্রথম ঘটালে!’
মামা বললেন, ‘এবার মহাগুরু আমাকে মহামন্ত্র দান করবেন, দেখবি তখন কী কাণ্ডটাই না ঘটাই!’
পটলার মনে হল, বাঘটার কপালটাই মন্দ ছিল, তার উপর বয়সও হয়েছিল। তাই এভাবে তাকে প্রাণ দিতে হল। আর পমকিনমামার নাম ছড়িয়ে পড়ল দেশে-বিদেশে!