Wednesday, March 26, 2025
Homeগল্প কথাঅখ্যাত শিকারি – বুদ্ধদেব গুহ

অখ্যাত শিকারি – বুদ্ধদেব গুহ

অখ্যাত শিকারি – বুদ্ধদেব গুহ

যার কাহিনি বলছি, তার নামে কোনোদিন ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল হবে না। এই নামটি লোকে চিরদিন মনেও রাখবে না।

তবু তোমাদের কাছে তার গল্প করছি এই জন্যে যাতে আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা অন্তত তাকে মনে রাখবে।

লোকটি একজন শিকারি। সে যে অঞ্চলে শিকার করে সেটা আসামের গোয়ালপাড়া জেলা। তার বাইরে সে শিকার করে না তা নয়, কিন্তু গোয়ালপাড়া জেলাতেই তার আধিপত্য বেশি।

নাম তার সাত্তার। ওর বাবা মারা গেছেন বাঘের হাতে, এর মধ্যে ওরও ঘোরা হয়ে গেছে হাসপাতাল বার কতক বাঘের থাবা খেয়ে। খেতে গরুকে বাঘে ধরেছিল বলে ওর বাবা একদিন গিয়েছিলেন গরুকে উদ্ধার করতে। সোজা গিয়ে গরুর ঘাড়ে বসে থাকা বাঘকে গুলি করলেন। গুলি লাগল গায়ে কিন্তু তিরের মতো ঝাঁপিয়েও পড়ল বাঘ সাত্তারের বাবার উপর, তার পর দুজনেই মাটিতে পড়ে গেলেন। সাত্তার তখন খুব ছোট, ভালো করে জানেও না বন্দুক চালাতে। সে চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে বাবার অবস্থা দেখে পাগলের মতো বাবার হাত থেকে ছিটকে পড়া বন্দুকটাকে নিয়ে বাঘের বুকে ঠেকিয়ে দিল ঘোড়া টিপে। বাঘ মারল কিন্তু ওর বাবা বাঁচলেন না। সাত্তার বলে, ওর সান্ত্বনা, তাও তো মেরেছে পিতৃহন্তাকে নিজ হাতে।

একটি রাতের গল্পই বলি আজ। সাত্তারের সঙ্গে চলেছি পায়ে হেঁটে কচুগাঁওয়ের জঙ্গলের কাছে। বন্দুকে টর্চ লাগানো রয়েছে। হঠাৎ ডানদিকে ছোটো ছোটো ঝোপের পাশে চারটে সবুজ চোখ জ্বলে উঠল। অমাবস্যার রাত, কালির মতো অন্ধকার চারদিকে, চাইলে চোখ ব্যথা করে, রাতও প্রায় দুটো। সাত্তার বলল হরিণ। কিন্তু জন্তু দেখা যাচ্ছিল না, শুধু চারটে চোখ কখনো সবুজ, কখনো নীল জ্বল জ্বল করছে, সে চোখের দিকে চাইলে গা ছম ছম করে। সাত্তার ফিস ফিস করে বলল, চলুন, মারা যাক। এগোলাম সন্তর্পণে। যখন বেশ কাছাকাছি এসেছি, আবার আলো জ্বালতেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। দেখি এক জোড়া বিরাট চিতাবাঘ, চুপ করে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে, লেজ দুটো শুধু এদিক-ওদিক করছে। সাত্তারকে ইশারা করলাম। বলল, ঠিক আছে, এগিয়ে চলুন, ঠিক মারা যাবে।

বলেই সে এগিয়ে যেতে লাগল, বাধ্য হয়ে আমাকেও যেতে হল ওর সঙ্গে। তখন আমরা বাঘের থেকে বড়ো জোর হাত পঁচিশেক দূরে, ওদিকে বাঘ আর বাঘিনি দুজনই কিন্তু গর গর করে আওয়াজ করতে আরম্ভ করেছে। সে আওয়াজে যেন অত্যন্ত বিরক্তি মাখানো। ততক্ষণে আমরা আরো এগিয়ে গেছি, কাঁধে লাগিয়েছি বন্দুক যাতে যখনই দরকার হয় তখনই ছুড়তে পারি। সাত্তার যে এখন কেন গুলি ছুড়ছে না আর আমাকেও মারতে বলছে না, বুঝতে পারছি না।

এদিকে বাঘেরা গর গর করেই চলেছে, লেজ আছড়িয়েই চলেছে। যে কোনো মুহূর্তে লাফিয়ে পড়তে পারে। আর লাফালে এই অমাবস্যার অন্ধকারে কেবলমাত্র টর্চ সম্বল করে গুলি করলে গুলি লাগবে কি না ভগবান জানেন। উত্তেজনায় ঘামতে থাকলাম আমি। আমরা তখন বাঘের প্রায় পনেরো হাতের মধ্যে এসে পড়েছি, এখন গুলি না করে ফেরার উপায়ও নেই। হঠাৎ, আমাদের সম্পূর্ণ চমকে দিয়ে বাঘিনিটা পিছনের জঙ্গলে ঢুকে গেল, এবং তার একটু পরেই বাঘটাও। যে ঝোপে তারা ঢুকল ঠিক তার পিছনেই একটা নালা ছিল, কোমর সমান জল প্রায় তাতে। বাঘ দুটো অদৃশ্য হতেই সাত্তার বলল টর্চ নিবিয়ে দিতে। নিবিয়ে দিলাম, নিবিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশে তখন মিট মিট তারার আলো।

এবার সাত্তার বলল, বসে পড়ুন মাটিতে। ওর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লাম। মাটি থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরুচ্ছে, পিটাস ঝোপের থোকা থোকা ফুল থেকে বিশ্রী একটা বুনো বুনো গন্ধ আসছে। আমরা নিঃশব্দে বসে আছি সেই ঝোপটার দিকে চেয়ে, যে ঝোপটাতে বাঘ দুটো অদৃশ্য হয়েছে হঠাৎ।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। এক মিনিট, দু-মিনিট, কত মিনিট কে জানে। ঝিঁঝিরা ডাকছে চিপ চিপ। ফিস ফিস করে সাত্তার বলল, বাঘ দুটো এক্ষুনি বেরুবে ওই শিশু গাছটার পাশ দিয়ে। খুব সাবধান, প্রথমে যেটা বেরুবে সেটাকে আমি ওইখানেই মারব, তারপর যেটা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আক্রমণ করবে, সেটাকে আপনার মারা চাই কিন্তু। উত্তেজনায়, ভয়ে আমার হাত ঘেমে গেছিল, তবুও সাহস দেখিয়ে বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু আমার কথা বলার আগেই বোধহয় হুড়মুড় করে ঝোপ ভেঙে বেরিয়ে এল বাঘটা সোজা আমাদের দিকে।

বিদ্যুতের মতো বেরিয়েই লাফ মারতে যাবে, কিন্তু লাফাবার আগেই সাত্তারের বন্দুক গর্জে উঠল। তীব্র আক্রোশে কাতরোক্তি করে বাঘটার সবল দেহ প্রায় গড়িয়ে এসেই থেমে গেল আমাদের কিছু সামনে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট গর্জন করে আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল কাঁপিয়ে লাফাল বাঘিনী আমাদের উপর। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে এত কাণ্ড ঘটে গেল। কী করে যে অতো তাড়াতাড়ি বিপদ এসে পড়ল, ভালো করে বোঝবার আগেই অস্পষ্ট আলোতে দেখতে পেলাম নখে দাঁতে চোখে মৃত্যুর ক্ষুধা নিয়ে লাফিয়ে পড়েছে, একটা আবছায়া প্রেত।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজ্ঞাতেই বন্দুক তুলে গুলি করলাম আর গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই সরে যেতে চেষ্টা করলাম একপাশে লাফিয়ে। কিন্তু সরতেও পারলাম না, তাড়াতাড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম একটা জংলি কুলঝোপের উপর মুখ থুবড়ে। তার পরক্ষণে কী ঘটে গেল মনে নেই, দিব্যচক্ষে ভেসে উঠল আমার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহ। কিন্তু আমার ভাবনারও আগে বোধহয় সাত্তারের বন্দুক আবার গর্জন করে উঠল, আর শুনতে পেলাম আমার কাছেই কুলঝোপের ঠিক পাশেই সেই বাঘিনির আছড়ে পড়ার শব্দ।

মনে হচ্ছিল যেন অজ্ঞানই হয়ে গেছি। সাত্তার সেদিন না থাকলে তোমাদের এই গল্প আর বলতে পারতাম না কোনোদিন। আমার গুলিটাও লেগেছিল, কিন্তু বাঘটা তখন প্রায় আমার মাথার উপরেই চলে এসেছিল। সেই বিপদের সময় একটুও বুদ্ধি না হারিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সাত্তার যদি না বাঘের বুক লক্ষ্য করে নির্ভুল গুলি করত তবে মৃত্যুই আমার সাথী হত।

যাই হোক, সে যাত্রা পুনর্জীবন লাভ করে যখন ভালো করে চাইলাম মাটির দিকে, ভারী আনন্দ হল, বাঘ আর বাঘিনিকে দেখে। মৃত্যুর দোসরেরা মৃত্যুর কোলে। চোখেমুখে তখনও হিংসার ভাব ফুটে রয়েছে তাদের।

ধন্য সাত্তারের সাহস, ধন্য তার নিশানা।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments