Wednesday, March 12, 2025
Homeমজার গল্পকিছুমিছু – জসীম উদ্দীন

কিছুমিছু – জসীম উদ্দীন

বাঙ্গালির হাসির গল্প – কিছুমিছু – জসীম উদ্দীন

বড় ভাই হরি প্রায়ই শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখানে তাকে কত খাতির-আদর করে। এটা-সেটা খেয়ে এসে নানারকম গাল-গল্প করে। ছোট ভাই নেপাল শুনে মুখ কাঁচুমাচু করে। তার তো বিবাহই হয় নাই। কে তাঁকে খাতির যত্ন করবে?

সেদিন নেপাল গিয়ে বড় ভাই হরিকে বলল, “দাদা, প্রতিবছর তুমি শ্বশুরবাড়ি যাও। কত কি খেয়ে আস, এবার নাহয় তোমার বদলে আমি যাব।”

বড় ভাই বলল, “আচ্ছা আমি এবার যাব না। তুই-ই আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসিস।”

শুনে ছোট ভাই ভারি খুশি। যাওয়ার সময় মা বলে দিল, “দেখ, তুই তো তোর দাদার শ্বশুর বাড়ি যাবি। সেখানে বউমা আছে। খালি হাতে কেমন করে যাবি। এই পাঁচটা টাকা নাও। একটা কিছুমিছু একটা কিনে নিস।”

মা মনে করেছিল, ছেলে বাজার হতে কোনো কিছু কিনে নিয়ে সেখানে যাবে। সন্দেশ, রসগোল্লা বা অন্য কিছু। কিন্তু নেপাল ভাবল, কিছুমিছু না জানি কি একটা নতুন জিনিস, বাজার হতে কিনে নিতে হবে। সে বাজারে গিয়ে এ দোকানে যায় সে দোকানে যায়। মনোহারী দোকানে কত রঙ-বেরঙের জিনিস সাজানো রয়েছে। সে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমার কাছে কিছুমিছু আছে নাকি?”

দোকানদার বুঝতে পারে না কিছুমিছু কি। তাই উত্তর দেয়, “নাহ, নাই।”

মনোহারী দোকান ছেড়ে সে মিষ্টির দোকানে যায়, তারপর হাঁড়ি পাতিলের দোকানে যায়, চাল-ডালের দোকানেও যায়।

“তোমাদের কাছে কিছুমিছু আছে নাকি? তোমরা আমাকে পাঁচ টাকার কিছুমিছু দাও তো।”

“এমন বোকা তো কোথাও দেখি নাই। কিছুমিছু আবার দোকানে বিক্রি হয়?”

তাদের কেউ তার গায়ে ধুলা ছিটিয়ে দিল, কেউ তার মাথায় কেরোসিন তেল মালিশ করতে আসল, কেউ তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিল। মনের দুঃখে সে খালি হাতেই ভাই-এর শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা হল।

পথে যেতে যেতে দেখা হল এক পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি গামছায় কিছু ধান-দূর্বাঘাস, তুলসী পাতা, বেলপাতা ইত্যাদি বেঁধে নিয়েছিলেন। চুপ করে পথ চলতে হয়রান হতে হয়। তার সঙ্গে গল্প করে পথ চললে পথের কষ্ট মনে পড়বে না। সে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠাকুর মহাশয়, গামছায় বেঁধে কি নিয়ে যাচ্ছেন?”

ঠাকুর উত্তর দিলেন, “কিছুমিছু নিয়ে যাচ্ছি।”

ছোট ভাই ভাবল, এবার তবে সে কিছুমিছুর খোজ পেয়েছে। সে ঠাকুর মহাশয়কে অনুনয় বিনয়ের সাথে বলল, “আপনি দয়া করে আমাকে এই কিছুমিছু দান করে যান।”

ঠাকুর উত্তর করলেন, “তা কেমন করে হবে, এগুলি তো আমার কাজে লাগবে।”

ছোট ভাই তখন আরো অণুনয়-বিনয় করে বলল, “এই পাঁচটি টাকা লন, কিছুমিছু আমাকে দিতেই হবে।”

পুরুত ঠাকুর ভাবলেন, যজমান বাড়িতে পূজা করে বড়জোর পাঁচ আনা পাব। আর এই ছেলেটি পাঁচ টাকা সাধিতেছে। গামছায় বাঁধা ফুল, বেলপাতা তো যেখানে-সেখানে পাওয়াই যায়। পথ হতে তুলে নিলেই হবে। কিন্তু গামছায় কি বাঁধা আছে এই বোকা ছেলেটি যদি বুঝতে পারে, তবে আর টাকা দিবে না। তাই প্রকাশ্যে তাঁকে বলল, “এগুলোর আমার দরকার ছিল, কিন্তু তুমি যখন এমন করে বলছ তোমাকে বেজার করতে চাই না। এই গামছা ধরেই কিছুমিছু নিয়ে যাও। পথে কোথাও খুলো না। বাড়িতে নিয়ে গিয়া তুলসী তলায় রেখে দিও।”

মনের সুখে সেই গামছা সমেত ফুল বেলপাতা নিয়ে ছোট ভাই খুব তাড়াতাড়ি পথ চলতে লাগল।

বড় ভাই-এর শ্বশুরবাড়িতে এসে সে পুঁটলিটি তুলসী তলায় রেখে চুপটি করে বসে রইল। তার ভাই-এর বউ একাজে, সে কাজে এদিকে এসে দেখল, দেবর তুলসী গাছের তলায় বসে আছে।

“ওকি! তুমি এখানে বসে আছ কেন? বাড়িতে সকলে কেমন আছে?”

মাঐ (বড় ভাইয়ের শাশুড়ি) এসেও জিজ্ঞাসা করল, “এই যে পুত্রা যে, তোমার দাদার তো আসার কথা ছিল। তা সে আসল না কেন?”

ছোট ভাই তো দাদাকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে তার বদলে কুটুম্ব বাড়িতে এসেছে। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না। সে কোনো উত্তর না করে তুলসী তলায় রাখা সেই পুঁটলিটি দেখিয়ে দিল।

পুঁটলিটি খুলে দেখে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের (হিন্দু ধর্মে মানুষ মরার পরের অনুষ্ঠান) জিনিসপত্র দেখে শাশুড়ী ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। হায়! হায়! তার জামাই তো মরে গিয়েছে, তাইতো পুত্রা (জামাইয়ের ছোট ভাই) ফুল-বেলপাতা আর শাখা-সিন্দুর নিয়ে সেই খবর ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি দিতে এসেছে। মায়ের কান্না দেখে মেয়েও আছাড়ি-পাছাড়ি কাঁদতে লাগল। তারপর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন সকলে মিলে কান্না জুড়ে দিল। কেউই তলাইয়া দেখল না কি হয়েছে।

ছোট ভাই এসেছিল দাদার শ্বশুর বাড়ি এটা-ওটা খেতে, সে খাওয়ার কপালে ছাই। সকলে মিলে কান্না জুড়েছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে সে বাড়ি ফিরে আসল। বাড়ি আসলে মা এসে জিজ্ঞাসা করে, বড় ভাই এসে জিজ্ঞাসা করে-“সেখানে গেলি আর ফিরে আসলি, তারা সব ভালো আছে তো?”

ছোট ভাই বলল, “সে বাড়িতে মানুষ মরেছে। তারা সব কান্নাকাটি করছে। তাই দেখে আমি চলে এসেছি।”

“কে মরেছে?”

জিজ্ঞাসা করতে ছোট ভাই বলল, “তা আমি কি করে বলব? আমাকে দেখে সকলে কেঁদে উঠল। তাই আমি বাড়ি চলে আসলাম।”

বড় ভাই ভাবল, নিশ্চয়ই তার বউ মরেছে। তাই ভাইকে দেখে সকলে কেঁদে উঠেছে। সে তখন কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুর বাড়ি ছুটল। শাশুড়ী ও বউ তাঁকে দেখে ঘিরে ধরল, “আমরা তো জানতাম তুমি মরে গিয়েছ!”

বড় ভাই বউকে বলল, “আমিও তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গিয়েছ!”

তখন সকলেই বোকা ভাইয়ের কাণ্ড দেখে অবাক হল।

“সমাপ্ত”

—————————————————————————————————————————————

জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। বাংলা সাহিত্যে পল্লী কবি উপাধিতে ভূষিত জসীম উদ্দীন এমনই এক ব্যাক্তিত্ব যিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments