জাদুর পুতুল ও তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – প্রথম পর্ব
অলস ভঙ্গিতে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড আটলান্টা’য় ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন গোয়েন্দা। বেড়াতে এসেছে রাসেদ পাশার সঙ্গে। তিনি এসেছেন জরুরী কাজে। রাস্তার মাটির নিচে কিছু দোকানপাট আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নিয়ে গড়ে উঠেছে জায়গাটা। একটা দোকান থেকে লেটেস্ট হিট অ্যালবাম কিনেছে রবিন। কিশোরের হাতে বুকস্টোর থেকে কেনা একটা ব্যাগ। মুসা কিছুই কেনেনি। ইয়া বড় এক কোন আইসক্রিম খাচ্ছে।
‘বাপরে, চারটে বাজে,’ ঘড়ির দিকে তাকালো কিশোর, ‘চলো হোটেলে যাই। গোসল করা দরকার। চাচার সাঁথে ডিনার। মনে আছে?’
মাথা ঝাকাল মুসা আর রবিন দু’জনেই। মনে আছে।
অদ্ভুত দোকানটা মুসার চোখে পড়ল প্রথমে। দোকানের সামনে বড় জানালা। কালো রঙ করা। এক কোনায় প্রমাণ সাইজের একটা নরকঙ্কাল ঝুলছে। ডিসপ্লেতে ঝাড়ফুঁক, ভূত-প্রেত, জাদু-মন্ত্র ইত্যাদির ওপরে নানা বই সাজানো।
‘অ্যাই, কিশোর,’ আঙুল তুলে দেখাল মুসা। ‘দেখো, সাইনবোর্ডটা। এখানে হাত দেখা হয়। চলো না, আমাদের ভাগ্যে কি আছে জেনে আসি।’
মুচকি হাসল কিশোর। আবারও ভাগ্য গণনা! গত বারের কথা ভুলে গেছ? জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, আমাদের মাথায় শিং গজীবে, তিনজনেরই।’
‘সম্ভাবনা এখনও ফুরিয়ে যায়নি,’হাসল রবিন, ‘এবার হয়তো বলবে লেজ গজাবে।’
স্টোরের ভেতরে ঢুকল ওরা। ডাইনীর গুহার আদলে সাজানো হযেছে ঘরটা। মৃদু আলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে, আশেপাশের সব কিছু ভূতুড়ে লাগছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে মিউজিক। দেয়ালে অদ্ভুত সব জিনিস সাজানো। কতগুলো বাক্স দেখা গেল! সেগুলোতে নানা ধরনের লেবেল সাটানো-’প্রেমের আরক’, ‘ঘৃণার আরক’, ‘কর্মজীবনে উন্নতির আরক’ ইত্যাদি । বড় বড় খোলা পাত্র আছে কত গুলো। অদ্ভুত সব জিনিসে ভরা। লেখা দেখে বোঝা যায় ওগুলোতে আছে কুকুরের চুল, গোসাপের চোখ, ময়ূরের যকৃৎ, সাপের খোলস এবং ম্যানড্রেক গাছের শিকড়।
‘শুকনো মাথাগুলো দেঁখো,’ একটা কাচের বাক্সে আঙুল দিয়ে দেখালো, ‘ভয়ঙ্কর লাগছে না?’
‘সাবধান না হলে আমাদের দশাও ওগুলোর মতই হতে পারে,’ঠাট্টা করল কিশোর।
মুসা বলল, ‘জায়গাটা জানি কেমন লাগছে আমার। ঠিক বোঝাতে পারব না।’
‘হ্যা, তা ঠিক,’ মাথা দোলাল রবিন। এই ভূতুড়ে আবহর মধ্যে গা ছমছম করছে ওরও।
‘ভয়ের কিছু নেই, এখানকার সব কিছুই সাজানো,’ নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।
‘মনে হচ্ছে যেন অ্যাজটেকের মন্দির। বলি দেয়ার ঘর,’ মন্তব্য করল কিশোর, এদিক ওদিক তাকাল, ‘কিন্তু কেউ নেই নাকি এখানে?’
যেন তার কথার জবাবেই খসখসে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ঘরের দূর প্রান্ত থেকে, ‘কি চাই?’ ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মহিলা। পরনে গোড়ালি ঢাকা কালো আলখেল্লা, লম্বা কালো চুল ঢেকে রেখেছে মুখের একটা পাশ।
মহিলার কালো চোখের তীর্যক দৃষ্টি, সবুজ আইশ্যাডো আর ঠোটের লাল টকটকে লিপস্টিকে তাকে ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে। ‘হাত দেখাতে চাই,’ ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। ‘কত লাগবে?’
‘দশ ডলার,’ জবাব দিল মহিলা।
‘আমার কাছে চার ডলার আছে, বলল মুসা। ‘চলবে এতে?’
ইঙ্গিতে কিশোর আর রবিনকে দেখিয়ে মহিলা বলল, ‘তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে নিতে পারো না?’
‘তিনজনে মিলিয়ে তিরিশ তো?’ মাথা নাড়ল কিশোর, ‘আমাদের কাছেও অত টাকা নেই। চলো, মুসা, আজ আর হাত দেখানো হলো না।’
হাত তুলল মহিলা, তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোমাদের আমার ভালো লেগেছে। যা আছে, তাতেই দেখে দেব। কে
আগে দেখাবে?’ ভ্রু কুচকে কিশোরের দিকে তাকাল মহিলা, ‘তুমি?’
মাথা কাত করল কিশোর। ‘আমার আপত্তি নেই।’
‘এসো আমার সঙ্গে।’
পেছনের ঘরে ঢুকল মহিলা।
‘খাইছে।’ চমকে গেল মুসা।
এ ঘরটা আগেরটার চেয়েও ভূতুড়ে। পুরো ঘর কালো মখমলে মোড়া। একটা বেগুনি রঙের বাতি জ্বলছে । সেই আলোতে সবার দাত আর চোখের মণিও বেগুনি দেখাল। ভয়ঙ্কর লাগল তাতে। হঠাৎ করেই মনে হতে, লাগল তিন গোয়েন্দার, এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না কোনদিন। সময় থাকতে পালাবে কিনা চিন্তা করতে লাগল মুসা। কিন্তু মহিলা ততক্ষণে নিচু, একটা টেবিলে বসে পড়েছে। ইশারা করল তার পাশে বসতে। টেবিলটা কালো মখমলে মোড়া। ওপরে একটা কাচের বড় বল। কিশোরের হাতের তালু মেলে ধরল মহিলা। চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। টেবিলের সামনে দুটো কুশনে বসেছে রবিন আর মুসা। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে মহিলার কাজকর্ম।
‘তোমার বয়স আঠারো,’ কিশোরের হাত দেখে অবশেষে বলতে শুরু করল মহিলা, ‘তুমি সাগরের ধারের কোনও শহরে, বড় একটা বাড়িতে বাস করো। সাংঘাতিক বুদ্ধিমান তুমি, ছাত্র হিসেবে ভাল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র আর কম্পিউটারে আগ্রহ। আরও একটা কাজে তুমি দক্ষ, কারও ওপর নজর… অর্থাৎ সতর্ক দৃষ্টি রাখা।’ এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল নিল সে। ‘তোমার জন্ম তারিখ কবে বলো।’ বলল কিশোর।
মহিলা তারিখটা লিখে কাগজের ওপর কতগুলো লাইন টানল। লাইনগুলো কাটাকুটি করে তারপর আঁকল একটা বৃত্ত। ‘ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাও!’ হঠাৎ বলে উঠল সে। সেও চেয়ে থাকল ক্রিস্টাল বলের দিকে। ঝাড়া এক মিনিট ওদিকে তাকিয়ে থাকার পরে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। ‘তুমি গোয়েন্দা!’ রেগে গেছে মহিলা, ‘তোমরা এখানে কেন এসেছ? আমার লাইসেন্স আছে। আমি অন্যায় কিছু করছি না। পুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না।’
‘আমি পুলিশের লোক নই, ম্যা’ম, তাকে আশ্বস্ত করল কিশোর, ‘আমরা আসলে শখের গোয়েন্দা। আপনার কাছে এসেছি শুধুই হাত দেখাতে। কোন মতলব নেই আমাদের।’
‘অ’ নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। অনেক প্রাইভেট ডিটেকটিভ আসে আমি তাদের নানা সাহায্য করি। দরকার হলে তোমরাও আমাকে ভাড়া করতে পারো! তোমাদের রহস্য উদঘাটনে অনেক সাহায্য করতে পারব।’
‘মনে হচ্ছে আপনার সেই ক্ষমতা আছে,’সন্দিহান সুরে বলল কিশোর। ‘আপনি আমাকে আগে কখনও দেখেননি। অথচ আমার সম্পর্কে সব বলে দিলেন।’
‘আসলে পত্রিকায় আমাদের ছবি দেখেছে,’ বলল রবিন, ‘আমাদের কেসের কথা তো মাঝে মাঝেই ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়।’
কড়া চোখে রবিনের দিকে তাকাল মহিলা। চেঁচিয়ে, উঠল, ‘তোমাদের নামও কোনদিন শুনিনি আমি। যা বলেছি, আমার জাদুর ক্ষমতার জোরেই বলেছি। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ঠিক আছে। হাত দেখা শেষ করি আগে। তারপর ঠিকই বিশ্বাস করবে।’
আবার ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকালো মহিলা। ‘আমি মোটর সাইকেল দেখতে পাচ্ছি। দুটো মোটর সাইকেল। তোমাদের মধ্যে একজনকে পেছনে বসিয়ে আনা হয়েছে,’ আবার উত্তেজিত শোনাল তার কণ্ঠ। ‘গোয়েন্দাগিরি তোমরা আগেও বহুবার করেছ। তবে এবার তোমাদের সামনে বিপদ দেখতে পাচ্ছি আমি। ভয়ানক বিপদ!’
‘অ্যাক্সিডেন্ট’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘না। নতুন কোন কেসে জড়িয়ে পড়বে তোমরা। দেখতে পাচ্ছি-দেখতে পাচ্ছি এক চোখো একটা লোককে। নীল চোখ। সাদা গাড়িতে চড়ে সে। খুবই বিপজ্জনক লোক। তার ধারে কাছেও যেযো না। লোকটার কাছ থেকে সব সময় দূরে থাকবে।’
মহিলার কন্ঠ জোরালো হয়ে উঠল। চেহারা দেখে মনে হলো সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে সে। চোখ বোজা। যেন জানে না কোথায় আছে। ‘সিলভার স্টার থেকে সাবধান!’ ফিসফিস করল সে। ‘ওখানে যেযো না।’
‘সিলভার স্টার কি?’ প্রশ্ন করল রবিন।
জবাব দিলো না মহিলা । খামচে ধরল কিশোরের হাত, ব্যথা পেল কিশোর ।
‘এক চোখো লোকটার কাছ থেকে সাবধান!’ ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে মহিলার। ‘সিলভার স্টার থেকে সাবধান! আমি – আমি সোনা দেখতে পাচ্ছি! অনেক সোনা । কিন্তু ওই সোনা অশুভ ধরতে যেয়ো না। ধরলে… ধরলে… মৃত্যু হবে। অই সোনাটাকে ঘিরে আছে মৃত্যু আর……’
হঠাত চোখ খুলল মহিলা বিষ্ফোরিত চাউনি। কিশোরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সিম্বু! সিম্বু আছে ওখানে! ওর কাছে যেযো না!’ তারপরই চোখ উল্টে দিয়ে, অজ্ঞান হয়ে কালো মখমলে ঢাকা মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে।
‘সর্বনাশ!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, ‘মুসা, রবিন-দেখো তো এখানে পানি-টানির বাবস্থা আছে কিনা। পানি, নিয়ে এসো।’
জ্যোতিষীর জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল কিশোর। সিঙ্ক থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এল রবিন। ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার মুখ মুছে দিতে লাগল কিশোর।
‘প্রথমে ভেবেছিলাম ভঙ্গি ধরেছে,’ কিশোর বলল। ‘এখন তো দেখি সত্যি সত্যি বেহুঁশ।’
‘কিন্তু মহিলা যেন কি বলছিল,’রবিনের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘হুশ ফিরলে জিজ্ঞেস করব,’ বলল কিশোর!
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে তাকাল মহিলা।
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ উৎকন্ঠিত গলায় জানতে চাইলো কিশোর।
ধীরে ধীরে মাথা দোলাল জ্যোতিষী। ‘ভীষণ শক্তিশালী কম্পন অনুভব করছি আমি! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আটলান্টা ছেড়ে চলে যাও তোমরা। তোমাদের অনুরোধ করছি আমি।
‘সিম্বুটা কে?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘কে, জানতে চাও?’ আস্তে উঠে দাঁড়াল মহিলা, ‘এসো আমার সঙ্গে।’
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বাইরের ঘরে চলে এল সে। শেলফ থেকে কিশোরকে একটা বই বের করে দিল মহিলা । ‘এটা পড়ো। সিম্বু কি জানতে পারবে। না, দাম দিতে হবে না। বইটা তোমাদের এমনিই দিলাম। এখন যাও। আর কোনদিন এদিকে এসো না। আমি গণনায় দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের ভাগ্য খারাপ!’
জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিশোর, মহিলার চেহারা দেখে চুপ হয়ে গেল। ভয় ফুটে উঠেছে মহিলার মুখে। তাতে কোন ভণিতা নেই।
‘চলো,’ দুই সহকারীকে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল কিশোর দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাড়াল। হাত নেড়ে মহিলাকে বলল, ‘গুড-বাই। আ্যান্ড থ্যাংক ইউ।’
‘উফ, বাচলাম!’ অদ্ভুত দোকানটা থেকে বেরিয়ে এসে যেন ছাপ ছাড়ল মুসা। ‘অভিজ্ঞতা একটা হলো বটে!’
রবিন বলল, ‘তুমিই তো ঢুকতে চাইলে’ চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোট কামড়াল কিশোর। ‘কি যেন রয়েছে ..ওই মহিলা আর তার দোকানের মধ্যে। আরেকটু হলেই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম তার কথা।’
ভরু কুঁচকাল মুসা অবাকহয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তারমানে, বিশ্বাস করোনি?’
হোটেলে ফিরে কিশোর গেল বাথরূমে। মুসা বিছানায় চিৎ। আর রবিন শুয়ে শুয়ে মহিলার দেয়া বইটা পড়তে শুরু করল। বইটি ভুডু চর্চার ওপরে লেখা।
ভুড়ু-তত্ত্বের জন্ম আফ্রিকায় হলেও হাইতি দ্বীপে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে চর্চা হয় বেশি। জাদুমন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক, নরবলি -এ সবের সাহায্যে কিভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বইটাতে। গোসল সেরে বেরিয়ে এল কিশোর।
রবিন বলল, ‘জাদু করে তোমাদের যে কারও হাত এখন ভেঙে দিতে পারি আমি। এ জন্যে শুধু একটা পুতুল দরকার হবে আমার। পুতুলের হাতে সুচ ঢুকিয়ে দিলে মনে হবে তোমাদের হাতেও সুচ ঢুকে গেছে। বাবারে- মারে বলে টেঁচানো শুরু করবে।’
লাফ দিয়ে উঠে বসল মুসা। ‘না না, প্লীজ, এখন ওকাজটিও কোরো না ভাই! পাশা আঙ্কেলের সঙ্গে ডিনারের দাওয়াতটা আগে সেরে নিই। হাতে ব্যথা থাকলে খাওয়াটা আর জমবে না।’
হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন, ‘তবে, এ বিদ্যেটাতে যদি বিশ্বাস না থাকে তোমার,’ বলল রবিন, ‘তাহলে আর কোন ভয়, নেই। তোমার ক্ষতি হবে না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ‘তাহলে এটা কি আর এমন ক্ষমতা হলো। পচা জাদু।’
‘সিম্বু কি জিনিস জানতে পেরেছ?’ আলমারি থেকে পরিষ্কার একটা শার্ট বের করল কিশোর।
‘ছোট মোটাসোটা একটা পুতুলের নাম সিম্বু’ রবিন বলল। ‘ভয়ঙ্কর চোখ জোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আছে বাইরে। এই যে, ছবিও আছে।’
তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল কিশোর।
সিম্বু দু’হাত শূন্যে তুলে রেখেছে। প্রতিটি, হাতে দশটা করে আঙুল। পা জোড়া ফাঁক করা। পায়েও দশটা করে মোট বিশটা আঙুল। কোমরে চওড়া বেল্ট।
‘বাপরে, চেহারা বটে!’ মন্তব্য করল কিশোর। ‘তা এই সিম্বুটা আসলে কে?’
‘দুর্লভ একটা চরিত্র,’ ব্যাখ্যা করল রবিন, ‘সিম্বু তার মনিবের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। এ ধরনের পুতুল এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে।’
ইদানিংসিম্বুর আদলে বেশ কিছু মূর্তি তৈরী করা হয়েছে। তবে কোনটাই আসল সিম্বুর ধারে কাছে যেতে পারেনি!’ বইটা কিশোর দিল ও। ‘নাও, তুমি পড়তে থাকো। আমি এই ফাঁকে গোসলটা সেরে আসি।’
কিশোর বসল বই নিয়ে। মুসাকে পড়ে শোনাল, ‘সিম্বুর কাজ হলো সব সময় তার প্রভুর পাশে থাকা, তাকে খারাপ লোকের হাত থেকে রক্ষা করা। কেউ সিম্বুর ক্ষতি কিংবা সে যাকে পাহারা দেয় তার ক্ষতির চেষ্টা করলে, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ে।
একবার হাইতিতে দুটো সিম্বুর পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। তারপর থেকে ঘটতে শুরু করল অঘটন। যারা ওগুলোকে খুঁজে পেয়েছিল রহস্যময় ভাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটল তাদের। তাতেও অঘটন বন্ধ হলো না। মিউজিয়ামের পানির পাইপ বিস্ফোরিত হতে লাগল, ছাতের ভারী আস্তর খসে পড়ে কাঁচের বাক্স চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে শেষে যেখান থেকে পুতুল দুটো আনা হয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়ে এল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বন্ধ হলো দুর্ঘটনা।’
খানিক পরে মুসা আর রবিনকে নিয়ে হোটেলের লবিতে চলে এল কিশোর! রাশেদ পাশা ওখানেই আছেন। কিশোরের হাতে একটা ব্রীফ্কেস। ওতে তার কিছু প্রযোজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। রাস্তায় নেমে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকলেন।
‘সিলভার স্টারে যাব, জানালেন তিনি ড্রাইভারকে।
‘কি!’ চমকে উঠল কিশোর। ‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘এই তো কাছের একটা রেস্টুরেন্টে।’ বললেন রাশেদ পাশা। ‘তোদের পছন্দ হবে। সিলভার স্টারের সী-ফুডও চমৎকার।’
তিন গোয়েন্দা আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে বসল ট্যাক্সিতে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে কোণের দিকে একটা টেবিল দখল করল। বিকেলের ঘটনাটা চাচাকে জানাল কিশোর।
‘সাদা গাড়িতে চড়ে নীল চোখো লোক?’ আনমনা ভঙ্গিতে বললেন রাশেদ পাশা, ‘এক চোখো। মনে হয় বুঝতে পারছি মহিলা কার কথা বলেছে।’
‘কার কথা?’ অবাক হলো কিশোর।
‘লোকটার নাম পিয়েরে দুপা,’ বললেন রাশেদ পাশা। ‘নষ্ট একটা চোখ ঢেকে রাখে সাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। সাদা মার্সিডিজ চালায়! ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর এক খুনী।’
‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা।
‘যখন পেশাদার গোয়েন্দা ছিলাম, দুঁপারসাথে বেশ কয়েকবার টক্কর লেগেছে আমার,’ রাশেদ পাশা বললেন। ‘কিন্তু লোকটা বান মাছের মত পিচ্ছিল। ওকে ধরার, জন্যে জাল গুটিয়ে এনেছি যতবার, ততবারই ও জাল ছিড়ে বেরিয়ে গেছে। ওর বিরুদ্ধে ডাকাতির বহু অভিযোগ এনেছি, লাভ হয়নি। সব সময় ফস্কে গেছে। মহা ধুরন্ধর এক লোক। তার কাজে যে-ই বাধা হয়ে দাড়িয়েছে, পথের কাটা দূর করতে দ্বিধা করেনি কখনোই।’
‘ওর বিশেষত্ব কি?’ জানতে চাইল কিশোর–
‘আ্যান্টিক চোর,’ জবাব, দিলেন রাশেদ পাশা। ‘বিবেক বর্জিত কিছু সংগ্রাহকের রাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, চড়া দামে। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে অবশ্য ওসব সংগ্রাহক তাদের সংগ্রহের প্রদর্শনী করার সাহস পায় না কখনোই। কি এক সাংঘাতিক নেশায় যেন তবু কেনে ওরা।
‘মহিলা জ্যোতিষী সিম্বুর কথা বলেছিল,’ বলল কিশোর। ‘আর সিম্বু হলো দামী অ্যান্টিক। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।’
মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ পাশা। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘কিন্তু দুপা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। সিম্বুর অভিশাপ থেকে একশো এমবি দূরে থাকার, কথা তার। অবশ্য প্রচণ্ড লোভ তাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে সেটা অনুমান করা কঠিন।’
‘আঙ্কেল, জ্যোতিবী মহিলা যে সব ভবিষ্যদ্বাণী করল, সেগুলো কি বিশ্বাস হয় আপনার?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।
শ্রাগ করলেন রাশেদ পাশা। ‘কে জানে! হয়তো কিছু ঘটার আভাস, পেয়েছে মহিলা। বাস্তব প্রমাণ। অভিশাপ, ভবিষ্যদ্বাণী-এ সব জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার। তবে জগতে ব্যাখ্যার অতীত বহু জিনিসই ঘটে। সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই।’
‘সিলভার স্টারে আসার পর পর থেকেই মনটা খচখচ করছে আমার,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
‘আমার ধারণা,’ কিশোর বলল, ‘দুপা যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেন সিম্বুকে পাবার লোভ ছাড়তে পারবে না কিছুতেই।’
কিশোরের কথা কানে গেলো না রবিনের। সে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে বিস্ময়ে। রবিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিশোর। হা হয়ে গেল মুখ।
‘ওই তো সেই লোক!’ ফিসফিস করল সে। ‘নীল চোখো লোকটা!’
রাশেদ পাশাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হলো না। দুপা নিজেই এগিয়ে এল তাদের টেবিলের দিকে। ‘মসিয়ে পাশা, আপনাকে আবার দেখে বুব খুশি হলাম,’ তার গলার স্বর তেলতেলে, বিরস।
‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি দুপা,’ বললেন রাশেদ পাশা। ‘কি চাও?’