হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)। তাঁর শাসনামলে সর্বাধিক অঞ্চল মুসলমানেরা বিজয় করেছে। তাঁর ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের শক্তিশালী করেছে। ইসলামের জন্য তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ কল্যাণ বয়ে আনলেও প্রথম দিকে মক্কার অন্যান্য মুশরিকদের মতো তিনিও ছিলেন ইসলাম, মুসলমান ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঘোর বিরোধী। কেউ ইসলাম গ্রহণ করেছে শুনলে তার ওপর নির্যাতন চালাতেন তিনি। নির্যাতন চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম নিয়ে আবারো নির্যাতন শুরু করতেন।
মুসলমানদের জন্য মূর্তিয়মান আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিল ওমর নামটি। রাসূল (সাঃ) একদিন দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! ওমরা অথবা আবু জাহেলের মধ্যে কোনো একজনকে আপনি ইসলামের জন্য কবুল করুন। তাদের কোনো একজন ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
রাসূল (সাঃ)-এর দোয়ার পরদিন ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ নিয়ে কোরাইশদের মজলিসে ওমর ঘোষণা করলেন, আজ আমি মুহাম্মদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিবো, তাঁকে স্তব্ধ করে দিলেই ইসলাম নামের ‘ফেতনা’র মূলোৎপাটন হবে। তাঁর ঘোষণায় কোরাইশেরা বেজায় খুশি হলো।
ওমর কোষবদ্ধ তরবারি নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খোঁজে বের হলেন। পথিমধ্যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। সাদ ওমরের গন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তিনি তাকে ফেরানোর উদ্দেশ্যে বললেন, মুহাম্মদকে পরে হত্যা করো, আগে তোমার বোনের খবর নাও, সেই-তো ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলাম তো এখন তোমার ঘরেই প্রবেশ করেছে। আর তুমি যাচ্ছো ইসলামের নবীকে হত্যা করতে!
এ কথা শুনে ওমর এর মেজাজ চরমে উঠে গেল। তিনি রাসূলের ঘরের পথ পরিবর্তন করে নিজ বোনের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। বোনের বাড়ির দরজায় গিয়ে শুনতে পেলেন তাঁর বোন ফাতিমা ও বোনের স্বামী সাঈদ ইবনে যায়দ (রাঃ) – কে কোরআন শিক্ষা দিচ্ছেন। তারা ওমরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে খাব্বার (রাঃ)-কে লুকিয়ে রাখলেন।
ওমর ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কী পড়ছিলেন? একথা বলেই তিনি ভগ্নিপতিকে মারতে শুরু করলেন। তাকে রক্ষা করার জন্য বোন ফাতিমা এগিয়ে এলে জাপটাজাপটিতে তাঁর মাথায় আঘাত লেগে রক্ত বের হতে শুরু করলো। এই পরিস্থিতি ওমরের বোন প্রচন্ড জেদ চেপে বলে বসলেন, হ্যাঁ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, তোমার যা ইচ্ছা করো।
এমন বেপরোয়া জবাবে ওমর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বোনের দিকে দৃষ্টি বুলাতেই খেয়াল করলেন তাঁর কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। বোনের এমন অবস্থা দেখে তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তোমরা আমাকে বলো তোমরা কি পড়ছিলে। ওমরকে শান্ত দেখে বোন আরও সাহসী হয়ে উঠে বললেন, এই বাণী পড়তে হলে তোমাকে গোসল করে পবিত্র হতে হবে।
ওমর গোসল করে এলেন। তাঁর ভেতর এমন পরিবর্তন দেখে খাব্বাব (রাঃ) আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ওমর তোমার ব্যাপারে গতকাল আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন।
এরপর খাব্বাব (রাঃ) তাঁকে সূরা ত্বহার প্রথম রুকু পর্যন্ত তিলাওয়াত শুনালেন। তিলাওয়াত শুনে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। তিনি খাব্বাবকে দ্রুত তাকে নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। খাব্বাব তাঁকে নিয়ে তাৎক্ষণিক দারুল আরকামের দিকে রওয়ানা দিলেন।
ওমরের হাতে তরবারি দেখে সাহাবিরা তাঁকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দিতে চাইলেন না, তাদের শঙ্কা ছিল তিনি রাসূলের (সাঃ) ওপর কোনো হামলা করে বসেন কিনা। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন। ওমর যেই তরবারি হাতে রাসূলকে হত্যার জন্য বের হয়েছিলেন সেই তরবারি রাসূল (সাঃ)-এর পায়ের কাছে আত্মসমর্পন করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কাবা প্রাঙ্গনে গিয়ে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করলেন। হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামী সংগঠনের শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেলো। এতদিন মুসলমানরা প্রকাশ্যে ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে পারছিল না; কাবা গৃহে জামাআতের সাথে নামায পড়াও ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পর অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটলো।
তিনি নিজেই প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। এ ব্যাপারে অনেক হাঙ্গামা হলো বটে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা কা’বা মসজিদে জা’মায়াতের সাথে নামায আদায় করার সুযোগ লাভ করলো; তাদের সংগঠনও আগের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হলো। পরন্ত আল্লাহর দরবারে আখিরী নবী (স)-এর দো’আ কতোখানি মঞ্জুর হয়েছিল, তাও বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করতে পারলো। দীর্ঘ চৌদ্দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও আজ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত ওমর (রাঃ)-এর দ্বারা ইসলামকে যে সম্মান ও মর্যাদা দান করেন, তার দ্বিতীয় কোনো নজীর নেই।