বাগানবাড়ি রহস্য – আনিসুল হক
১. চপল ভয়-পাওয়া গলায় বলল
চপল ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কী হলো কাদের ভাই?
কাদের মৃধা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে, চাবি ঘুরিয়ে বারবার গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে, ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।
চপলের গলা আরও মিইয়ে গেল, এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরেন। জায়গাটা ভালো না।
সন্ধ্যা সময়টা আসলেই রহস্যময়। সন্ধ্যা মানে না দিন, না রাত। দিন আর রাতের মিলনক্ষণ। কিন্তু ভোরের সঙ্গে সন্ধ্যার একটা পার্থক্য আছে। ভোরের মধ্যে আশা আছে, একটা আলোকিত দিনের প্রতিশ্রুতি আছে। সন্ধ্যার মধ্যে আছে অনিশ্চয়তা, সে সংকেত দিচ্ছে, সামনের সময়টা ঘোরতর অন্ধকার।
এমনকি নিজের বাড়িতেও সন্ধ্যাবেলা একা থাকলে মন খারাপ লাগে।
আর বনজঙ্গলের মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলে ভয় না পেয়ে উপায় আছে? তাও যদি অনিশ্চিত যাত্রাপথের মাঝামাঝি কোনো অজানা জঙ্গলের ধারে নির্জন রাস্তায় ঠিক সন্ধ্যার মুখে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়, তখন গা ছমছম তো করবেই।
একটু আগে চপল গান ধরেছিল, ‘চলো না ঘুরে আসি, অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।’ চপলের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল তার দুই বন্ধু জাহিন আর স্বাধীন। এখন তাদের দুজনের গলা দিয়েও যেন কোনো স্বর বেরুতে চাইছে না।
তবু ফিসফিস কণ্ঠে জাহিন জিজ্ঞেস করল, জায়গাটা ভালো না মানে কী, চপল ও চপল!
চপল সে কথার জবাব না দিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে কাতর স্বরে বলল, কাদের ভাই, স্টার্ট দেন তাড়াতাড়ি। আপনার গাড়ি নষ্ট হওয়ার জায়গা পেল না। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়।
জাহিন আর্তস্বরে বলল, কী বলিস চপল! এখানে বাঘের ভয় আছে নাকি!
স্বাধীন বলল, না, ঠিক বাঘের ভয় না। তাই নারে চপল?
চপল বলল, হ্যাঁ বাঘের ভয় না। অন্য কিছু। তুই ভয় পাস না। আমরা আছি না? আর গাড়ি তো স্টার্ট নেবেই। কাদের ভাই দেখেন না কী হলো।
কাদের গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে দেখতে লাগল। হাতের মোবাইল ফোনটাকে টর্চ বানিয়ে আলো জ্বালল। গভীর অভিনিবেশ-সহকারে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে এসে বলল: বুঝতাছি না কী হইল। সবকিছু ঠিক আছে। স্টার্ট নেয় না ক্যান?
চপল বিস্ময়মাখা কণ্ঠে জিগ্যেস করল, সব ঠিক আছে?
কাদের ড্রাইভার বিজ্ঞের মতো ভঙ্গি করে বলল, জি। সব ঠিক আছে।
চপল বলল, স্টার্ট নিচ্ছে না?
কাদের মাথা নাড়ল, জি না।
চপল দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীর ছেড়ে দিয়ে বলল, যা ভেবেছিলাম তাই।
জাহিন মিহি স্বরে বলল, কী ভেবেছিলি চপল?
স্বাধীন সবজান্তার ভঙ্গি করে বলল, চপল ভেবেছিল, এই জায়গাটা ভালো না। রহস্যময় ঘটনা ঘটে। অনেকটা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো। ভূত-প্রেত কিছু একটা থাকতে পারে।
জাহিন যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছে। ভূত বলতে কিছু নেই। তবে বাঘ-ভালুক, সাপখোপ তো থাকতেই পারে। সে বলল, এই কী বলিস। বাঘ নাকি ভূত-প্রেত?
স্বাধীন বলল, দুইটাই থাকতে পারে।
কাদেরও মাথা নাড়ছে, হ। দুইটাই থাকবার পারে। এই জায়গায় গতবার আমি তিনটা লাশ পইড়া থাকতে দেখছিলাম। কাফনের কাপড় পরা লাশ।
জাহিন কান্নামাখা স্বরে বলল, এসব কী বলছেন কাদের ভাই!
কাদের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আল্লাহর নাম নেন। আমার মনে হয় কিছু একটা আমগো ওপরে ভর করছে। নাইলে গাড়ি স্টার্ট লয় না ক্যান?
চপল বলল, কাদের ভাই। আপনার দুটো পায়ে পড়ি। গাড়ি স্টার্ট দেন। একটা কিছু করেন।
কাদের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল, গাড়ি ঠেলতে হইব। আপনেরা তিনজন নামেন।
জাহিন বলল, আমি গাড়ি থেকে নামতে পারব না।
কাদের বলে, জাহিন ভাইজান। সমস্যা কী? তিনজন একসাথে থাকেন। বাঘ, ভূত-প্রেত যাই আসুক। তিনজন একসাথে থাকলে বল পাইবেন।
স্বাধীন জাহিনের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, আরে নাম, নাম, কী হবে! ভূত তো গাড়ির ভেতরেও ঢুকতে পারে, তাই না?
জাহিন চোয়াল শক্ত করে বলল, নারে স্বাধীন। তোরা নাম। কাদের ভাই আপনার কাছে দিয়াশলাই হবে?
কাদের বলল, ক্যান ভাইজান?
জাহিন বলল, আগুন জ্বালব। আগুন দেখলে নাকি ভূত কাছে আসতে সাহস পায় না।
কাদের বলল, দিয়াশলাই নাই। লাইটার আছে। লন।
জাহিন লাইটার নেয়। আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে। পারে না। আশ্চর্য। লাইটারের খাপটা খুলছে। স্ফুলিঙ্গ উঠছে। কিন্তু আগুন ধরছে না।
জাহিন কাঁদ কাঁদ গলায় বলে, আগুন জ্বলে না তো কাদের ভাই?
চপল আর স্বাধীন গাড়ির পেছনে যায়। তাদের চোখে-মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি।
তারা গাড়ি ঠেলার চেষ্টা করে। কাদের স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে।
গাড়ি স্টার্ট নেয় এবং সবেগে চলতে শুরু করে।
স্বাধীন মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তায়। ব্যথাও পায়।
আস্তে আস্তে ঠেস দিয়ে বসে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। দেখে চপল দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে।
স্বাধীন বলে, এই এই, আমাকে ছেড়ে কই যাস তোরা। কাদের ভাই ও কাদের ভাই। গাড়ি থামান।
গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটছে স্বাধীন। একটা মোড় ঘুরতেই যা ঘটে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না স্বাধীন।
সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে লাল আভা। শরতের আকাশে মেঘের গায়ে অনেক রং।
ফাঁকা রাস্তা। আঁঁকাবাঁকা। এক পাশে ঘন জঙ্গল। আরেক পাশে সবুজ খেত। জলা, জংলা। হঠাৎই একটা ছায়ামূর্তি এসে স্বাধীনের পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
স্বাধীন চমকে ওঠে। তার বুকের মধ্যে দুন্দুভি বাজে।
একটা লোক, তার মাথার চুল এলোমেলো, গালভরা অযত্নে বড় হওয়া দাড়ি, লোকটার গায়ে একটা ছেঁড়া কোট, পরনে কালো ঢোলা প্যান্ট, তার সামনে হাত বাড়িয়ে বলে, দে। দে। পাগলকে হেলা করিস না। বিশটা টাকা দে। ভাত খামু।
স্বাধীন উল্টা দিকে দৌড় ধরে। সে সত্যি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। তার বুক ধড়াস ধড়াস করে কাঁপছে।
খানিকক্ষণ দৌড়ানোর পরে স্বাধীনের হুঁশ হয়। তার বন্ধুরা মাইক্রো নিয়ে যেদিকে চলে গেছে, সে দৌড় ধরেছে তার বিপরীত দিকে। এখন এই নির্জন জংলি রাস্তায় সে একা। আশেপাশে কোনো জনবসতির চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।
অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। সন্ধ্যাতারা জ্বল জ্বল করছে আকাশে। চপলটা যা চপল প্রকৃতির আর জাহিনটা যা বোকাসোকা, তাতে তারা তাকে ফেলে রেখেই চলে যেতে পারে। আর পরে হয়তো চপল ফোন করে বলবে, দোস্ত, রাতটা কোনোরকমে গাছের নিচে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দে, কাল দিনের বেলা তোকে নিতে গাড়িটা পাঠাচ্ছি। স্বাধীন ফোন করে চপলের নম্বরে।
চপল ফোন ধরে—চপল: হ্যালো…স্বাধীন বল।
ওপাশ থেকে স্বাধীন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, এই আমাকে ফেলে রেখে কই গেলি তোরা। আমি মারা যাচ্ছি ভয়ে। তোরা গাড়ি ঘোরা। আমাকে তুলে নিয়ে যা।
ওদিকে গাড়ি আবার থেমে যায়।
কাদের বলে, আবার স্টার্ট বন্ধ হইয়া গেল। জায়গাটা ভালো না। তেনারা এইহানে নানা কাণ্ডকীর্তি করেন।
জাহিন মিনমিন করে জিগ্যেস করে, ওনারা কারা।
কাদের ফিসফিস করে বলে, রাতের বেলা তাগো নাম নেওয়া বারণ।
চপল ফোনে বলে, গাড়ির স্টার্ট আবার বন্ধ হয়ে গেছে।
স্বাধীন আকুল স্বরে বলে, তাহলে তোরা এসে আমাকে নিয়ে যা।
চপল বলে, আরে আমরা তো ওইখানেই আছি। বেশি দূর আগাইনি। তুই আয় না বাবা।
স্বাধীন বলে, না। আমি পারব না। এই রাস্তায় আমি একটা…
চপল বলে, একটা কী?
স্বাধীন বলে, একটা ভয়ংকর লোক রাস্তার মাঝখানে…চপল, ভাই বলে ডাকছি, সারা জীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব। ভাই, এসে নিয়ে যা।
চপল বলে, আচ্ছা আসছি। সে ফোন রেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়লে জাহিন তাকে টেনে ধরে, এই কই যাস। আমাকে একা ফেলে রেখে যাবি না বলে দিচ্ছি।
চপল বলে, স্বাধীন বিপদে পড়েছে। ওকে উদ্ধার করে আনতে হবে। তুইও চল।
জাহিন বলে, বিপদ? না না। আমি যাব না। তুইও যাস না। স্বাধীনকে চলে আসতে বল।
চপল বলে, না। ও ভয় পাচ্ছে। কী যেন একটা ভয়ংকর জিনিস ও দেখেছে। ওকে নিয়ে আসি।
চপল নেমে যায় গাড়ি থেকে। স্বাধীনের সন্ধানে হাঁটতে থাকে। মোড়ে ঘুরতেই তার সামনেও আচমকা এসে পড়ে একজোড়া হাত। নোংরা কোট পরা দুটো হাত। ক্যান আই গেট টাকা টোয়েন্টি অনলি?
এই নির্জন পথে অদ্ভুত পোশাক পরা উসকোখুসকো দাড়ি-গোঁফসমেত একটা মানুষ কোত্থেকে এল? চপল এমনিতেই সাহসী ছেলে। কিন্তু তারও পিলে চমকে যায়।
লোকটা তার পথ আটকে দাঁড়ালে সে বিপন্ন বোধ করে।
কিন্তু এত সহজেই ভেঙে পড়ার পাত্র তো নয় চপল। সে একটু পিছিয়ে যায়। তারপর বলে, গেট আউট অফ মাই ওয়ে, সরে দাঁড়াও।
লোকটা খানিকটা ভড়কে যায় বলেই মনে হয়। চপল তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যায় স্বাধীনের সন্ধানে।
জাহিন গাড়িতেই বসে ছিল।
গাড়ির ইঞ্জিনের ওপরের ঢাকনা খুলে কাদের কী যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
তারপর সে বলে, জাহিন ভাই, আপনি থাকেন। আমি একটু ঘুইরা আসি।
জাহিন আকুতি জানায়, না-না, কাদের ভাই। আপনি যাবেন না।
কাদের বলে, আরে আমারে যাইতেই হইব। জরুরি কাম আছে। বুঝেন না ক্যান।
কাদের হনহন করে হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেলে জাহিন ভয়ে মরমর হয়ে পড়ে।
রাত ঘন হয়ে আসছে। দূরে শেয়াল ডাকছে। আর নানা রকমের পোকার ডাক। জোনাকি জ্বলছে।
জাহিন খানিকক্ষণ দমবন্ধ করে গাড়িতে বসে থাকে। আশায় আশায় থাকে, হয়তো এখনি কাদের কিংবা চপল বা স্বাধীন এসে যাবে। তাদের ফেরার নাম নেই।
জাহিন গাড়ি থেকে নামে।
যতদূর পারা যায়, গলায় জোর এনে ডাকে, চপল, চপল, স্বাধীন, স্বাধীন…
তার সেই ডাক প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।
এই সময় হঠাৎ গাড়ির ওপরে একটার পর একটা ঢিল পড়তে থাকে। জাহিন এদিক-ওদিক দেখে।
ঢিল কে ছোড়ে?
এই সময় পায়ের শব্দ। কে যেন আসছে।
পেছনে ঢিল পড়লে সে সেদিকে তাকায়।
তখন কে যেন ফিসফিস করে কানের কাছে বলে ওঠে, বিশটা টাকা দেন। ভাত খামু। প্লিজ গিভ মি টাকা টোয়েন্টি অনলি। প্লিজ…
জাহিন গাড়ির দিকে দৌড় ধরে। তখন তার সামনে ঢিল পড়তে থাকে। সে ফেরার চেষ্টা করে। রহস্যময় ভয়ংকর দর্শন ফকিরটা সামনে এসে দাঁড়ায়।
জাহিন বুঝতে পারে না সে কী করবে, তার কী করা উচিত। একটা শেয়াল দৌড়ে রাস্তা পার হয়। একঝাঁক বাদুড় আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে থাকে।
জাহিনের মনে হতে থাকে, সে এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
তখন দূরে মুণ্ডুহীন দুটো শরীর নড়তে থাকে। জাহিনের সেদিকে চোখ চলে যায়। সে এক দৌড়ে গাড়ির কাছে যায়, দরজা খোলে, আর ভেতরে ঢুকে গাড়ি লক করে দেয়। বাইরে হিহি করে কারা যেন হাসছে। আর জঙ্গলের ভেতরে একটা গাছের ডালে ডালে কারা যেন নৃত্য করতে থাকে।
জাহিন চোখ বন্ধ করে কানে হাত দেয়। সে যত দোয়া জানে সব পড়তে আরম্ভ করে। বাইরে প্রচণ্ড শব্দ, গাছের ডালে তোলপাড়, ওইখানে নাচছে দুটো মুণ্ডুবিহীন মানব শরীর, ঢিল পড়ছে ধুপধাপ, আর একটা ভয়ানকদর্শন মানুষ ইংরেজিতে বলে যাচ্ছে, ডেঞ্জার, ডেঞ্জার…দে আর কামিং…ডেঞ্জার ডেঞ্জার…
তখন গাড়ির ভেতরে একটা মানব শিশু ওঁয়া ওঁয়া শব্দে কেঁদে ওঠে।
গাড়ির মধ্যে বাচ্চা এল কোত্থেকে।
জাহিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
গাড়িটা একা পড়ে আছে রাস্তার ধারে। গাড়িতে আর কেউ নেই।
জাহিন একা এবং অচেতন।
কোট পরা লোকটা তখন তার কোটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট চাকু বের করে।
কাদের সেই সময় এদিকটাতেই আসে। তার হাতে মোবাইল ফোন কাম টর্চ। সেই টর্চের আলো সে সামনে ফেলতেই কোটপরা লোকের চাকুতে আলো পড়ে ঝিলিক দেয়।
কাদের ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। লোকটা তখন চিৎকার করে ওঠে, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। বহুদিন মাংস খাই না। আজকে মাংস খাব। ক্যান ইউ লেন্ড মি টাকা ফিফটি অনলি।
আবার ঢিল পড়তে থাকে।
আর গাড়ির ভেতর থেকে বাচ্চা মানুষের কান্না ভেসে আসে আবারও। কাদেরের কানে সেই কান্নার আওয়াজ গেলে সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলে উল্টো দিকে দৌড় ধরে।
কোটপরা লোকটা হাসতে থাকে হো হো শব্দে।
গাছের ডালে তখন যেন ডাইনির মাতম। সমস্ত বনভূমিতে যেন ঝড় বয়ে যায়। দূরে জলাভূমির ওপরে আগুন জ্বলে ওঠে। বাগানবাড়ি যাত্রাপথটা যেন হাইওয়ে টু হেল হয়ে ওঠে।
২. চপল আর স্বাধীন
চপল আর স্বাধীন শরীর থেকে বড় কাগজের ঠোঙা দুটো খুলে ফেলে। অনেক বড় কাগজের ঠোঙা, মানুষের সমান সাইজ, উল্টো করে পরেছিল তারা। চোখের কাছে ফুটো ছিল দুটো করে, কাজেই এটা পরেও চলতে অসুবিধা হয়নি। এই ঠোঙা পরা অবস্থায় চপল দেখছিল স্বাধীনকে, স্বাধীন চপলকে, একে অন্যকে দেখে চমকেই উঠেছিল। সত্যি, দেখতে মুণ্ডুহীন মানুষের মতোই লাগছে।
এই ঠোঙার বুদ্ধি চপলের। সে-ই দুটো বড় ঠোঙা বানিয়ে এনে রেখেছিল গাড়ির পেছনে লুকিয়ে। জাহিন ছেলেটা গোবেচারা ধরনের, তাকে ভয় দেখানোর মাহাত্ম্যই আলাদা।
কিন্তু স্বাধীন তো নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
একটা ঠোঙা নিজের গায়ে চাপিয়ে আরেকটা স্বাধীনের মাথায় চাপাতে চাপাতে চপল তাকে বলছিল, এই গাধা, তুই আবার ভয় পাচ্ছিস কেন?
স্বাধীন ভয় পাওয়া গলায় বলছিল, ওই লোকটা…
কোন লোকটা?
ওই লোকটা। কোট-প্যান্ট পরে যে কিনা ইংরেজিতে ভিক্ষা চায়।
একটা ফকিরকে দেখে ভয় পেয়ে গেলি?
ওটা ফকির। নাকি অন্য কিছু?
গাধা। পৃথিবীতে অন্য কিছু বলে কিছু নাই।
স্বাধীনও সে কথা বিশ্বাস করতে চায় বটে। কিন্তু এই নির্জন বনপ্রান্তে এই রকম সন্ধ্যাবেলা একটা কোট-প্যান্ট পরা লোক আসবেই বা কোত্থেকে, ভিক্ষাই বা চায় কেন? সে জিজ্ঞেস করেছিল, জাহিনের কী অবস্থা?
চপল বলেছিল, তুই সব জেনেশুনে ভয় পেয়ে যাচ্ছিস। আর ও তো আমাদের ষড়যন্ত্রের কিছুই জানে না। আর এমনিতেই জাহিন একটা ভিতুর ডিম। এখন কাদেরের যা যা অ্যাকটিং করার কথা যদি ঠিকভাবে করে থাকে, তাহলে জাহিন এতক্ষণে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলেছে।
চল, তাড়াতাড়ি চল। দেখি কী অবস্থা।
ততক্ষণে ওদের মুণ্ডুহীন প্রাণীর সাজ পরা হয়ে গেছে।
জাহিনকে তারা ভয় দেখায়। আর তাদের নির্দেশ ও পরিকল্পনামতো কাদের ঢিল ছুড়তে থাকে।
তাতেই জাহিন অজ্ঞান।
চপল আর স্বাধীন গাড়ির কাছে যায়।
গাড়ির দরজা খোলে। মাইক্রোবাসের মাঝখানে জাহিনের দেহখানা পড়ে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না।
স্বাধীন বলে, সর্বনাশ, মরেটরে যায়নি তো।
চপল বলে, বুক তো ওঠা-নামা করছে। সে তার মোবাইল ফোন দিয়ে টর্চ জ্বালায়। জাহিনকে ধরে দেখে, না, মরেনি, মনে হয় ফিট হয়ে গেছে।
গাড়িতে পানির বোতল ছিল। তারা তার চোখে-মুখে পানির ছিটা দেয়। খানিক পরে জাহিনের জ্ঞান ফিরে আসে।
চপল আর স্বাধীন হাঁপ ছাড়ে। ব্যাটা যদি মরেটরে যেত, তাহলে কী কেলেঙ্কারিই না হতো!
জাহিনকে তারা অভয় দেয়। বলে, জাহিন, ভয় পাস না। ভয়ের কিছু ঘটে নাই। পরে বলব সব।
চপল হাঁক ছাড়ে, কাদের, গাড়ি স্টার্ট দাও। চলো। এখান থেকে গেস্টহাউসটা কত দূর?
কাদের বলে, আধা মাইল হইতে পারে।
সে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করে। স্টার্ট নেয় না।
সে বলে, আপনেরা হাঁইটা যান। আমি দেখি, গাড়ি কী করা যায়। নাইলে গেস্টহাউস থাইকা লোক পাঠান। গাড়ি ঠেইলা নিমু।
চপল বলে, কাদের, গাড়ি স্টার্ট দাও। চলো।
কাদের বলে, গাড়ি তো স্টার্ট নিতাছে না ভাইজান। আপনে দেখেন।
চপল বলে, চল, হেঁটেই যাই। জাহিন, হাঁটতে পারবি?
জাহিন বলে, একা একা থাকার চেয়ে হাঁটা সোজা। চল।
কাদের রয়ে যায় গাড়ির কাছে। গাড়ি পেছনে ফেলে রেখে সেই ঘুটঘুটে আঁধারের মধ্যে তারা পথ চলতে থাকে। জাহিনের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। একটু আগেই সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল ভয়ে। এখনো তার শরীর ঠিক হয়নি। ভয়টা তাকে পেয়ে বসেছে। পথের ধারে জঙ্গল, অন্ধকার, বড় বড় গাছ, তাতে বাদুড়েরা পাখা ঝাপটাচ্ছে। মানবশিশুর গলায় কান্নার আওয়াজ আসছে। সে স্বাধীনের কাঁধে হাত রাখে। তার শরীরে ভর দিয়ে হাঁটে। স্বাধীনের শরীরের ওম তাকে কিছুটা সাহসও দেয় যেন।
রিসোর্টটা আসলে কাছেই। একটা মোড় ঘুরতেই গেস্টহাউসের গেটের আলো দেখা যায়।
তারা গেট খুলে ভেতরে ঢোকে। চিৎকার করে ওঠে চপল, এই কে আছ? ঢাকা থেকে ভিআইপি গেস্ট এসে গেছে।
তাদের স্বাগত জানান গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান। কোমর বাঁকা একজন মানুষ। বয়স ৪০-ও হতে পারে, ৬০-ও হতে পারে। তিনি বলেন, আপনাদের আসতে দেরি হইল মুনে লয়।
চপল বলে, আমরা আসব আপনাকে তো আমরা বলি নাই।
দারোয়ান চপলের পিঠের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বলেন, খবর তো ঠিকই পাই।
স্বাধীন বলে, খবর তো পাবেনই। আচ্ছা আমাদের তিনজনকে তিনটা রুম দিচ্ছেন তো?
দারোয়ান বলেন, না। তিনজনরে একটা রুম দিতে হইব। আরেকটা রুমে আরও দুজন গেস্ট আইতাছে।
স্বাধীন বলে, তাহলেও তো আরেকটা রুম থাকবে।
জাহিন বলে, আমি আলাদা ঘরে থাকতে চাই না।
স্বাধীন বলে, আমি থাকতে চাই।
চপল বলে, ঠিক আছে। আমি আর জাহিন এক রুমেই থাকি।
জাহিন যেন ধড়ে জান ফিরে পায়—সে-ই ভালো। তবে আরও ভালো তিনজন এক রুমে থাকা।
চপল বলে, আচ্ছা দুটো রুম যখন পাওয়া যাচ্ছে নিয়ে নিই।
দারোয়ান রুম দেখিয়ে দেন। বাইরে থেকে গেস্টহাউসটাকে একটা পোড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল। রুমগুলো খারাপ নয়। দুটো করে সেমি ডাবল বেড। সাদা চাদর, সাদা বালিশ। রঙিন কম্বল। তাতে কভার নেই, সেটাই একটু সমস্যা।
স্বাধীন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি ঢুকছে বাগানবাড়িটিতে।
কার গাড়ি?
গাড়ি পার্ক করে কাদের এগিয়ে আসে স্বাধীনের কাছে।
হাসিমুখে বলে, স্যার, আপনারা চইলা আইলেন। আর আমি চাবি ঘুরাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট নিল। কী তাজ্জব ব্যাপার। এইটা ভূতের বাড়ি তো। এইখানে কী কাণ্ডকারখানা যে ঘটব, কেউ এইটা আগে থাইকা কইতে পারে না।
স্বাধীন হাসে। সে জানে কাদের পুরোটাই অভিনয় করছে। তবু এই অন্ধকার বাগানবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকটা যেন একটু কেঁপে ওঠে। ওই রহস্যময় ইংরেজি জানা ভিখারিটাকে তার সত্যি সত্যি অশরীরী কিছু বলেই মনে হয়!
কাদের দুই হাত কচলাতে কচলাতে বলে, স্যার, ৫০টা ট্যাকা দেন।
স্বাধীন বিরক্তিভরে বলে, কেন?
কাদেরের ওপরে বারান্দার হলুদ বাতির আলো পড়েছে, তার ছায়া মাটিতে, সে ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে স্বাধীন। ছায়াটা নড়ে ওঠে, ছায়ার ঠোঁট নড়ে—স্যার। সব কাজের দাম আছে, খালি অভিনয়ের কি দাম থাকব না? কী রকম অভিনয় করতে হইতাছে। আপনাগো শিখায়া দেওয়া কথা কী রকমভাবে কইয়া যাইতাছি। আমার প্যাট ফাইটা হাসি আহে। হাসতে পারি না।
চপল যে আগে থেকে কাগজের ভূত বানিয়ে এনেছে, স্বাধীন তা জানত না। চপল তার পরিকল্পনাটা স্বাধীনকে জানায় রাস্তায়। পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে তারা চা খায়। জাহিন একটু জঙ্গলের দিকে হাঁটতে যায় একা একা।
স্বাধীনকে একা পেয়ে জাহিন বলে, স্বাধীন। শোন। জাহিনটা তো বোকাসোকা আছে। আর ভিতু টাইপের। আমরা একটা কাজ করি। ওকে ভূতের ভয় দেখাই।
স্বাধীন বলে, আচ্ছা। খুব মজা হবে।
কাদের ছিল গাড়িতে, বলে, ভাইজান। ভালো মানুষরে ভয় দেখায়া মজা পাইয়া কী লাভ।
চপল বলে, মজা তো মজাই। শোনেন কাদের ভাই। আপনি আমাদের গেস্টহাউসটার কাছে গিয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেবেন। তারপর বলবেন, জায়গাটা ভালা না। নানা রকম ভূতপেতনির আসর আছে। আমরা যখন জিজ্ঞেস করব এখানে গাড়ির স্টার্ট কেন বন্ধ হলো, তারপর বলবেন, পাশেই একটা গেস্টহাউস আছে। যেইটা নাকি ভূতপ্রেতের আখড়া। আমরা দেখব জাহিনের রিঅ্যাকশনটা কী হয়। তারপর নানাভাবে ওকে ভূতের ভয় দেখাব। কী কাদের ভাই, পারবেন না?
কাদের বলে, চেষ্টা কইরা দেখি। জীবনটা অভিনয়ের ওপরেই রাখছি। সারাক্ষণ তো অভিনয়ই করতাছি।
স্বাধীন বলে, কী রকম?
কাদের বলে, এই ধরেন টাকার দরকার। মালিকরে কই গাড়ি গ্যারাজে নেওয়া লাগব। মালিক কয় তোমারে নিতে হইব না, আমি গ্যারাজে গিয়া বইয়া থাইকা কাম করামু। হে নিজেই বইয়া থাকল। বিল দিয়া গেল। আমি আবার মেকানিকের কাছে গিয়া হাজির হই। ওই মিয়া আমার ভাগ কই। ধরেন কাম মানে তো ফাঁকি। সে আমারে দিয়া দিল ফিফটি ফিফটি। বউরে গিয়া কই আজকা আইতে দেরি হইব। খ্যাপ লইয়া সিলেট যাই। আসলে তো ধরেন বইয়া বইয়া বন্ধুগো লগে তাস খেলতাছি। এই রকম কত অভিনয় যে করন লাগে।
চপল অভিভূত, বলে, আমি তো মুগ্ধ। কাদের ভাই। আপনার প্রতিভায় আমি মুগ্ধ। আপনাকেই আমরা খুঁজছি। আপনি ভূতের ভয় দেখাবেন। জাহিন হলো আমাদের টার্গেট। ওরে নাকানিচুবানি খাওয়াব।
কাদের বলে, আচ্ছা। আপনারা আমার ওপরে ভরসা রাখেন। দেখি কতটা পারি।
তা অভিনয় কাদের ভালোই করেছে।
এখন তো চোরের ওপরে বাটপারি করতে সচেষ্ট। এসে টাকা চাইছে—বুঝেন। আপনাগো কথামতো অভিনয় করতাছি। মাত্র পঞ্চাশটা টাকা চাইছি। এইটা কোনো টাকা?
স্বাধীন বলে, অবশ্যই টাকা। পঞ্চাশ তো অনেক টাকা। পঞ্চাশ টাকা মানে পঞ্চাশটা টাকা।
কাদের বলে, ভাইজান, অভিনয় করা খুব কষ্টের কাজ। এই জন্য দেখেন, যারা নায়ক-নায়িকা, তারা কত টাকা পায়। শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান—এরা সবাই নাকি কুটি কুটি টাকা নেয়। আমি তো কুটি কুটি টাকা চাই নাই। মাত্র পঞ্চাশ টাকা চাইছি। দিয়া ফেলান ভাইজান। আর তা ছাড়া জায়গাটা আসলেই ভালো না। ধরেন, আপনে যে আমারে দেখতেছেন, আমি কাদের, আমি তো কাদের নাও হইতে পারি। এমনও তো হইতে পারে, আসল কাদের ওইখানে গাড়ি সারতেছে। আর আমি নকল কাদের। আপনের কাছ থেকে টাকা নিতে আইছি। মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিলেই যদি আমি যাই, সেইটা কি ভালো না?
স্বাধীন একটু ভড়কে যায়। তবে কাদের না আবার নিজেকে তার চেয়ে স্মার্ট প্রমাণ করে বসে, সেটা যেন না হয়, এই চিন্তা থেকে সে বলে, তোমাকে পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি, এর এক নম্বর কারণ টাকাটা তোমার দরকার, দুই নম্বর কারণ তুমি গল্পটা ভালো বানিয়েছ বলে। নাও।
স্বাধীন মানিব্যাগ খুলে দুইটা বিশ টাকা আর একটা দশ টাকা বের করে কাদেরের হাতে দেয়।
কাদের হাসে, বলে, থ্যাংক ইউ।
কাদের চলে যায়। তখন এলাকাটায় একটা শূন্যতা এসে ভর করে। স্বাধীন ধাতস্থ হয় এবং ভাবে, কাদের তাকে এইভাবে আউটস্মার্ট করে দিতে পারল। আর সেও ভেবে বসল, এটা সত্যিকারের কাদের নয়। কেউ কাদের সেজে তার কাছে এসেছে। তার মতো একটা শিক্ষিত ছেলে ভূতে বিশ্বাস করে বসল। মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে সংশয়ী করে তোলে।
নিজের কাছে নিজেও যেন ধরা খেয়েছে স্বাধীন। সে যে সাহসী, এটা তো প্রমাণ করাও দরকার। মন থেকে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার যত অমূলক ভয়। ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই, তবে ভূতের ভয় বলে জিনিসটা একেবারেই বাস্তব।
স্বাধীন বারান্দা থেকে নামে। বাইরে হাঁটাহাঁটি করে।
রিসোর্টটার ভেতরেই সে হাঁটছে। পেছনের দিকে আর কোনো বাউন্ডারি নেই। একটু উঁচু-নিচু টিলা। পায়ে চলা পাহাড়ি পথও আছে একটা। এই দিক দিয়ে বোধ হয় লোকজন নিয়মিত যাতায়াত করে। ওই দূরে বসতবাড়ি দেখা যাচ্ছে। তাদের চলাচলের শর্টকাট পথ বোধ হয় এটিই।
হাঁটতে হাঁটতে স্বাধীন একটু বেশি দূরেই চলে এসেছে।
হঠাৎ তার কাঁধে কে যেন হাত দেয়।
সে চমকে উঠে ঘুরতেই দেখতে পায় সেই কোট-প্যান্ট পরা লোকটাকে, সে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলে, ক্যান ইউ গিভ মি টাকা টুয়েন্টি অনলি? আই নিড টু বাই ফুড।
স্বাধীন তাকে ধাক্কা দিয়ে উল্টো দিকে দৌড়াতে থাকে।
সোজা চলে আসে রিসোর্টে।
ঢুকে যায় রুমে।
জাহিন তখন গোসল সেরে এসে কাপড় পাল্টাচ্ছে।
স্বাধীন গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
জাহিন বলে, এই কী হয়েছে?
স্বাধীন বলে, না, কিছু না। কিছু না।
তুই হাঁপাচ্ছিস কেন?
একটু দৌড়ে এলাম তো, তাই।
দৌড়ালি কেন?
গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছল। তাই?
ভয়ের কিছু দেখেছিস?
না, তেমন কিছু না।
কী দেখেছিস? বল।
আরে না।
বল না।
তোকে বললে তুই বেশি ভয় পাবি।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলার দরকার নাই।
রাতের খাওয়া তারা খায় ডাইনিং টেবিলে বসে। কেয়ারটেকার নিজের হাতে পরিবেশন করেন। গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম অমলেট। বলেন, কাল সকাল থেকে খাওয়া ভালো হবে। আজকে দেরি করে আসায় তিনি বাজার করে রাখেননি।
জাহিন আর স্বাধীন একটা রুমে শোয়। আলাদা বিছানা। শরীরটা ক্লান্ত ছিল। জাহিন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।
জাহিন ঘুম থেকে উঠে দেখে স্বাধীন আগেই উঠে গেছে। রোদে চারপাশ ঝকঝক করছে। সে আইপডে স্পিকার যুক্ত করে গান বাজাচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীত বাজছে: ‘গ্রামছাড়া এই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে…’
জাহিনও বিছানা ছাড়ে।
বারান্দায় গিয়ে তার মনটা একেবারে তরতাজা হয়ে যায়। কত আলো চারদিকে। কত সবুজ। আকাশ কত নীল। দূরের পাহাড়গুলোকেও নীল দেখাচ্ছে। কাছের পাহাড়গুলোকে দেখাচ্ছে সবুজ।
নাশতার টেবিলে আসে গরম গরম পরোটা। আলুর দম। আর সবজি।
তারপর চা আসে। গরুর দুধের চা। চা নিয়ে ওরা চলে আসে বারান্দায়।
জাহিনের মনে পড়ে, গত রাতে সে কী রকম ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
আর স্বাধীনের মনেও পড়ে না যে আগের রাতটায় কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল।
চপল তো এদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া। ভয়ভীতি জিনিসটা তার অভিধানে নেই।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চপল বলে, চল, চারপাশটা দেখে আসি। রেকি করে নিয়ে রাখা ভালো।
চল।
পায়ে চপ্পল, পরনে কোয়ার্টার প্যান্ট, তারা চলে পায়চারি করতে।
জাহিন বলে, আসলে আমি না অন্ধকারকে ভয় পাই। দিনের আলোয় আমার সাহস ঠিক থাকে। দেখ, এখন কিন্তু ভয় লাগছে না।
চপল হাসে, ও আচ্ছা, তুই শুধু রাতে ভয় পাস। দিনে না। ঠিক আছে।
স্বাধীন বলে, আমি দিন হোক, রাত হোক, কখনোই ভয় পাই না।
চপল হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, ‘সাপ সাপ।’
স্বাধীন ‘ওরে বাবা রে’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরে।
চপল হাসে।
চপল বলে, ভয় নাকি পাস না?
স্বাধীন ধাতস্থ হয়ে বলে, সাপ-বাঘ তো ভয় পাবই। ভূতপ্রেত এসব আধিভৌতিক জিনিসে বিশ্বাস করি না। তাই ভয়ও পাই না।
চপল তার পিঠ চাপড়ে বলে, আচ্ছা আচ্ছা। বেশ বেশ।
হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা রাবার বাগানে ঢুকে পড়ে। বেশ ঘন বন।
তার ভেতর দিয়েই চলে গেছে পায়ে চলার পথ।
একটা জায়গায় গিয়ে জঙ্গলটা অন্ধকার হয়ে আসে। এতক্ষণ রোদে হেঁটে ছায়াপথটা বেশ আরামদায়ক বলেই মনে হয়।
বেশ সুনসান নীরবতা। শুধু পোকার কিটকিট শব্দ কানে আসে। পাখিও ডাকে।
এই নীরবতা ভেদ করে তাদের কানে আসে নারীকণ্ঠে হাসির শব্দ।
তিনজনেই সচকিত হয়, কান খাড়া করে।
চপলই প্রথম মুখ খোলে, কে হাসে? এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে নারীকণ্ঠের হাসি? আমার তো ভালো মনে হচ্ছে না। কে এই রহস্যময়ী নারী? নাকি পরি-ফরি কিছু।
স্বাধীন চপলের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে, যাহ। অশরীরী কিছু এই দুনিয়ায় নাই।
ওরা দুজনে আশা করেছিল, জাহিন ভয় পাবে। কিন্তু ওদের বিস্মিত করে দিয়ে জাহিন বলে, হাসিটা কিন্তু খুব সুন্দর। চল, হাসিটা কে হাসছে খুঁজে বের করি।
রাতের বেলা হলে জাহিন কক্ষনো এ কথা বলত না। কিন্তু দিনের বেলায় নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দ পেলে তরুণদের পক্ষে কৌতূহল দমন করা মুশকিল। ভয়ের চেয়েও তখন বড় হয়ে ওঠে কৌতূহলই।
স্বাধীন মজা দেখতে চায়, জাহিনকে সে ঠেলে দিতে চায় বনের গহিন নির্জন পথে। তারপর নিশ্চয়ই জাহিন ভয় পাবে। কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসবে তাদের কাছে।
স্বাধীন বলে, চল, তিনজন তিনদিকে যাই।
আসলেই সামনে পায়ে চলার সরু পথ তিন ভাগ হয়ে গেছে। এবং তিন দিকেই জঙ্গলের ভেতরে গাছের পাতা নড়াচড়া করছে। তাতে মনে হচ্ছে তিন দিকেই কেউ না কেউ আছে।
স্বাধীন বলে, আমি এই দিকটায় গেলাম।
চপল বলে, যাহ। আমি তাহলে এইটাতে যাই।
স্বাধীন আর চপলের পথ দুটো প্রায় পাশাপাশি।
উল্টো দিকে একলা পথে তারা ঠেলে দেয় জাহিনকে।
স্বাধীন এগিয়ে যায়। এদিকে গাছপালা বড় ঘন। তার এগোতে অসুবিধা হয়। আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা ছাগল ভ্যা ভ্যা বলে ডেকে ওঠে।
চপল তার পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই ডাক শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
জাহিন এগোচ্ছে। নারীকণ্ঠের হাসিটা মনে হয় ওদিক থেকেই আসছে। তার বুকটা একটুখানি কেঁপেও ওঠে যেন। দূর থেকে সে দেখতে পায় একটা লাল রঙের চাদর। নীল রঙের জামা। তার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে।
সে এগোতে থাকলে দেখতে পায় এক তরুণীকে। বেণি করা চুল। নীল ফতুয়া, জিনস, একটা লাল র্যাপার জড়ানো। তার ধন্দ লাগে। সে মুগ্ধ হয়। সে ভয় পায়। তার মনে হয়, এ এক অশরীরী অস্তিত্ব।
আর চপল আরেক দিকে মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে সেদিকে যায়।
সে দেখতে পায়, হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। সে তার মুখ দেখতে পায় না। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলে নীল শাড়ি ঘুরে দাঁড়ান। চপল দেখতে পায়, একজন বয়স্বিনীকে, যার বয়স ষাটও হতে পারে, সত্তর হওয়াও বিচিত্র নয়।
ওরা তিনজনে ফিরে আসে।
চপল বলে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর দেখা পেয়েছি এইমাত্র।
স্বাধীন বলে, আমি কিছু দেখি নাই।
চপল বলে, তুই কি দেখবি। তোর প্রতিবিম্ব দেখেছিস, ম্যা ম্যা করছিল…হা হা হা…
জাহিন কিছুই বলে না। বর্ণনার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে।
কী রে কী দেখেছিস, বল…চপল জাহিনের পিঠ চাপড়ে বলে।
জাহিন বলে, হাসিটাই খালি সুন্দর না, মেয়েটাও খুব সুন্দর রে…
স্বাধীন গান ধরে: ‘বুকটা ফাইট্টা যায়, বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়।’
জাহিনের সত্যি কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে, কী ধরনের কষ্ট, সে বলতেও পারছে না।
তারা হাঁটে। গল্প করে। একটা ঝরনা খুঁজে পায়। দুই টিলার মধ্যখানের সরু উপত্যকা বেয়ে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। বেশ গভীরে। তারা টিলার শানু বেয়ে নেমে যায়।
বড় বড় পাথরখণ্ডের ফাঁকফোকর দিয়ে জলধারা ছুটে যাচ্ছে। শেওলাধরা পাথর। সেই পাথরে পা রেখে তারা সাবধানে পানিতে হাত দেয়।
কী ঠান্ডা!
নামাটা যত সহজ ছিল, ওঠাটা তত সহজ হয় না। গাছ ধরে ধরে তারা ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
ফেরার পথে জাহিন ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে নীল জামা লাল চাদরকে!
পায় না কোথাও।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গেস্টহাউসের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তাদের চোখে পড়ে নীল জামা লাল চাদরকে। বারান্দায় বসে আছে।
বাকি দুজনকে অবাক করে দিয়ে জাহিন তরুণীর দিকে এগিয়ে যায়।
বলে, আমার নাম জাহিন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বোটানি। আপনার হাতে যে পাতাটা, এটা কি চেনেন? এটা হলো চা-গাছের পাতা। আপনি জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছেন। এর সায়েন্টিফিক নেম হলো ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস।
ওমা। এটাই ক্যামেলিয়া নাকি? রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে। নাম তার ক্যামেলিয়া, দেখেছিলাম খাতার ওপরে লেখা।
না। ওই ক্যামেলিয়া একটা ফুলের নাম। ক্যামেলিয়া সাসানকুয়া। খুব সুন্দর ফুল। আপনার নাম কী?
আমার নাম শিশির।
শিশি?
না না। শিশির। ডিউ।
ও আচ্ছা। রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর নাম শিশির হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাহার নাম দিলেম শিশির।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর নাম শিশি বোতল হতে পারে, কেউ ভাবতে পারে? আপনি এটা কী ভাবলেন?
সত্যি। বোকার মতো ভেবেছি। আসলে শুনতে ভুল শুনেছি।
এই সময় বাগানবাড়ির টিনের চালে ঢিল পড়তে থাকে।
জাহিন চমকে ওঠে।
শিশির বলে, ঢিল পড়ে কোত্থেকে?
কী জানি। রাতের বেলা তো নানা ভৌতিক কাণ্ড ঘটেছে। দিনের বেলায়ও ঘটবে নাকি?
রাতের বেলা ভৌতিক কাণ্ড ঘটেছে নাকি?
কাল ঘটেছিল। আজ কী ঘটবে, তা তো জানি না।
ঢিল পায়ের কাছে এসে পড়ছে।
জাহিন বলে, চলেন ভেতরে যাই।
শিশির বলে, সেই ভালো।
জাহিন বলে, কেমন ভয় ভয় লাগে না! কী সব ভুতুড়ে কাণ্ড।
শিশির বলে, ভয় লাগুক না লাগুক, গায়ে ঢিল পড়লে তো ব্যথা লাগবেই।
তারা ভেতরে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। সেখানে সেই ভদ্রমহিলা আর চপল গল্প করছে।
শিশিরকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন, শিশির আয় আয়। কী কাণ্ড শোন। আমাদের তো মনে হয় আজকেই বেলা থাকতে থাকতে এই বাগানবাড়ি ছেড়ে দেওয়া উচিত।
শিশির বলে, কী হয়েছে দাদি?
ভদ্রমহিলা, শিশিরের দাদি, বলেন, এই জায়গাটা নাকি ভালো না। নানা রকমের ভৌতিক কাণ্ড ঘটে থাকে। কাল রাতে ওরা নাকি ভূত দেখেছে।
শিশির বলে, ভূত না থাকতে পারে। মানুষ তো সব জায়গাতেই আছে। অনেক সময় মানুষও অনেক ভৌতিক কাজ করে। কী হয়েছে বলুন তো।
চপল বলে, আমরা কালকে নানা রকমের রহস্যময় ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমাদের গাড়ির স্টার্ট অকারণে বন্ধ হয়ে গেল। কেন বন্ধ হলো, কেউ জানি না। আবার নিজে থেকেই স্টার্ট নিল। কেন নিল, তাও জানি না।
তারপর একযোগে ঢিল। ঝোড়ো বাতাস। বাদুড়ের পাখা ঝাপটানি। কী সব ভৌতিক কাণ্ড।
সেই টেবিলে এসে যোগ দিল স্বাধীনও। সে বলে, আর সবচেয়ে রহস্যময় একজন মানুষ। কোট-প্যান্ট পরা। ইংরেজিতে কথা বলেন। ভিক্ষা চান। আউট অব দ্য ব্লু এসে হাজির হন। ভয়াবহ ব্যাপার।
জাহিনের আবারও ভয় ভয় লাগছে।
চপল বলে, আসলে এই বাগানবাড়িটার একটা ইতিহাস আছে।
এটা ছিল ব্রিটিশ সাহেবদের। সাহেবেরা এখানে এসে থাকত।
একবার এক সাহেব এখানে এসে মারা যায় তার ঘোড়ার ছুড়ে মারা গুলিতে।
ঘোড়ার ছুড়ে মারা গুলিতে? শিশির বিস্মিত। ঘোড়া কখনো গুলি ছুড়তে পারে?
পারে না। কিন্তু একবার পেরেছিল। আমাদের ধারণা, এটা একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে ওই ইংরেজ সাহেব, তার নাম ছিল অ্যান্টনি, ঘোড়াটাকে অকারণে চাবুক দিয়ে পিটিয়েছিল। তাই ঘোড়া তার প্রতিশোধ নিয়েছে। সাহেবের বন্দুকটা রোদে শুকাতে দেওয়া ছিল। সেটা সে মুখে করে আনে। দুই পায়ে সেটার ট্রিগার টেপার চেষ্টা করে। সাহেব তা দেখতে পেয়ে বন্দুকটা কেড়ে নিতে এগিয়ে যায়। এই সময় সাহেবের আঙুল লেগে নাকি ট্রিগারের সঙ্গে লতাপাতা পেঁচিয়ে ঘোড়ার খুরে লেগে কে জানে, গুলি বেরিয়ে যায়। সাহেবের গলা ভেদ করে সেই গুলি চলে যায়। সাহেবকে অপারেশন করেন আরেক ব্রিটিশ সার্জন জন।
যাহোক, পরে ঘোড়াটার বিচার হয়। এক ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়াটাকে গুলি করে মারার রায় ঘোষণা করেন।
এই বাগানবাড়িতেই ঘোড়াটাকে গোরা সৈন্যরা গুলি করে মারে।
এরপর ওই ম্যাজিস্ট্রেট এখানে বেড়াতে আসেন স্ত্রীসমেত।
তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এই টিনের বর্গাগুলোর সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
এর পরও একটা নবদম্পতি হানিমুন করতে এসে এখানে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।
তার পর থেকেই…
কে কে? কে ওখানে? একটা ছায়ামূর্তি ডাইনিং রুমে জানালায়…
৩. চপল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে
চপল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। ‘কে…কে…’ বলতে বলতে সে ছুটে চলে যায় বাইরে।
কে এই ছায়ামূর্তি? তাকে চপল ধরতে চায়? নাকি সে অভিনয় করছে? স্বাধীন ভাবে।
জাহিনের চোখে-মুখে আতঙ্ক।
দিনের বেলা বলেই হয়তো ভয়ে সে মূর্ছা যায়নি। তবে এত গাছগাছড়া বাড়িটার চারদিকে, দিনের বেলাতেও এলাকাটা অন্ধকার হয়ে আছে। কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। ডাইনিং রুমের পেছনের জানালাটার ওপারে গাছ আর গাছ। শেওলা জমে আছে মাটিতে, দেয়ালে। নানা ধরনের লতা-গুল্ম। ভূত-প্রেত না থাকুক, সাপখোপ যে আছে, তাতে জাহিনের অন্তত সন্দেহ নাই।
স্বাধীন উঠে এগিয়ে যায় দরজা পর্যন্ত, জাহিন ভয়ে ছিটকে গিয়ে হাত ধরে ফেলে শিশিরের।
তখন বাইরে খুব জোরে একটা শব্দ হয়, আর তার পরেই আসতে থাকে শিশুর কান্নার আওয়াজ।
শব্দটা এত জোরে হয় যে শিশিরও জাহিনের হাত খামচে ধরে।
ওদিকে ততক্ষণে চপল বাইরে ভবনটার পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কলাগাছের পাতা সরিয়ে এগোয়। খসখস ধপধপ শব্দ হয়।
স্বাধীন আর চপল বারান্দায় পাশাপাশি বসা। দুটো বেতের চেয়ার। এখানে বসলে পাহাড়ের ভিউটা ভালো দেখা যায়।
স্বাধীন বলে, চপল, তোর মাথায় এত দুষ্টুমি বুদ্ধি কী করে আসে?
চপল হাসে। আমার বুদ্ধি মোটেও দুষ্টুমি বুদ্ধি নয়। সব কাজের বুদ্ধি।
কাজের বুদ্ধি?
হ্যাঁ।
স্বাধীন বলে, আচ্ছা বল তো, বাচ্চার কান্নার আওয়াজটা কোত্থেকে আসে?
কোন বাচ্চার আওয়াজ?
একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। আমিও শুনেছি। জাহিনও বলছিল। গাড়িতে নাকি সে শুনেছে একটা বাচ্চা কাঁদছে।
চপল বলে, ওই দেখ, কী সুন্দর একটা ফুল। নীল রঙের ফুল দেখতে আমার যা ভালো লাগে না। এক কাজ কর তো। একটা ফুল আর দুটো পাতা তুলে আন।
কী করবি?
শিশির মেয়েটাকে দেব।
তুই দিবি। তুই আন। আমাকে দিয়ে খাটাচ্ছিস কেন?
আরে আন না। এই ফুল দেব জাহিনকে। বলব, শিশির তোকে দিয়েছে।
ব্যাপারটার মধ্যে একটা মজা মজা গন্ধ পায় স্বাধীন। সে ফুল তুলতে এগিয়ে যায়। বারান্দা থেকে নেমে ঘাসের ওপরে পা রাখে। ফুলটা সত্যি সুন্দর। কী গাছ এটা? ঝাঁকড়া একটা পাতাওয়ালা গাছ।
এরই মধ্যে সে হঠাৎ শোনে, একটা মানবশিশু কেঁদে উঠল।
কোত্থেকে এল এই কান্নার আওয়াজ। স্বাধীন ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়েছে লনটায়। চারদিকে ভয়হীনতার আশ্বাস। এর মধ্যে একটা বাচ্চা কাঁদে কোথায়? কার বাচ্চা?
স্বাধীন কোনো কিছু ঠাওর করতে পারে না।
স্বাধীনের ভয় পাওয়া দেখে চপল হাসে।
আয়, এদিকে আয়। ফুলটা নিয়ে আয়—চপল বলে।
স্বাধীন কাছে আসতেই আবারও শিশুকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ।
যন্ত্রণা তো।
চপল হাসতে হাসতে বলে, আরে গাধা। এইটা আমার সেকেন্ড মোবাইল সেটের রিংটোন। এটাতে যখনই আমি রিং করি, বাচ্চা ছেলে কেঁদে ওঠে। ওই যে ওইখানে পেপারের আড়ালে বাজছে। এইটাই গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম জাহিনকে ভয় দেখানোর জন্য। যখনই যেখানে কান্নার আওয়াজ দরকার হয়, এটাতে রিং দিই। হা হা হা…
স্বাধীনও হেসে ওঠে। কিছুটা নিজের বোকামিতে, কিছুটা চপলের বুদ্ধির তারিফ হিসেবে। কিছুটা চপলের হাসিতে সংক্রমিত হয়ে।
স্বাধীন বলে, ওই সময় বিল্ডিংয়ের পেছনে কে এসেছিল রে চপল?
চপল বলে, বুঝলাম না। আমি ভাবলাম কাদের। কিন্তু বেরিয়ে দেখি, কাদের গাড়ি মুছছে। ওটা কাদের ছিল না।
স্বাধীন বলে, কাদের না থাকলে কে হতে পারে?
চপল গম্ভীর মুখে বলে, এইটাই তো এখন ভাবনার কথা।
স্বাধীন বলে, তোর যে কত কিছু ভাবতে হয়। দোস্ত, এত রসিকতা তুই কোথায় জমিয়ে রাখিস। মাথায় না পেটে?
চপল বলে, না না, সিরিয়াসলি, তখন বারান্দায় কে এসেছিল, আমি কিছুই জানি না। জানার চেষ্টা করছি।
স্বাধীন বলে, আর দোস্ত, তোর ওই ইংরেজ সাহেবের ঘোড়া গুলি করেছে, এই গল্পটা বেশি গাঁজাখুরি হয়ে গেছে। তুই কিন্তু যতটা রসিক আছিস, গল্পকার হিসেবে ততটা ভালো না। আরও কিছু গল্পের বই তোকে পড়তে হবে।
আরে আমি বানিয়ে গল্প বলেছি নাকি। কক্ষনো না। এটা যে কেউ জানে। তুই কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস কর।
আচ্ছা আচ্ছা করব জিজ্ঞেস, ঘোড়া গুলি করেছে না বলে তুই বাঁদর গুলি করেছে বলতে পারিস। তোর গল্পটা অবশ্য ‘দ্য বেল অব জাস্টিস’ নামের একটা গল্পের সঙ্গে মিলে যায়। একটা ঘোড়াকে তার মালিক পরিত্যাগ করে। ঘোড়াটার না খেয়ে মরার অবস্থা। তখন সে একটা লতা খেতে শুরু করল। সেই লতার সঙ্গে বাঁধা ছিল শহরের ন্যায়বিচারের ঘণ্টা। ঘণ্টা বেজে উঠল। তখন নগর কর্তৃপক্ষ ছুটে এল। ঘোড়ার মালিককে বলা হলো, ঘোড়াটাকে ঠিকমতো খেতে দাও। কিন্তু ঘোড়া গুলি করতে পারে, এই গল্পটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি চপল, বলে স্বাধীন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগল।
শিশিরের খামচিতে দাগ বসে গেছে জাহিনের কবজিতে। তাতে অবশ্য জাহিন খুশিই।
খানিক পরে সে হাজির হয় শিশির আর তার দাদির রুমের দরজায়। নক করে, কাশি দেয়।
দাদি বলেন, কী ব্যাপার জাহিন, তোমার কি সর্দি-কাশি হয়েছে নাকি?
জাহিন বলে, না সর্দি-কাশি হয়নি।
হলে বোলো। আমার কাছে নানা ধরনের ওষুধ আছে।
সেই জন্যই এসেছি, জাহিন বলে। স্যাভলন ক্রিম হবে?
স্যাভলন ক্রিম দিয়ে কী করবে? দাদি বলেন।
এই যে এখানে একটু ছড়ে গেছে। দেখুন কী রকম লাল দাগ হয়ে গেছে?
কীভাবে হলো? দাদি আঁতকে ওঠেন।
এই তো একটু ব্যথা পেয়েছি।
ঘরের ভেতরে শিশির, চোখ সরু করে ঘটনা দেখছে আর ওদের কথা শুনছে। জাহিন কবজির দাগ দেখাচ্ছে দাদিকে। সে খানিকটা লজ্জা পেল বলেই মনে হয়!
বিকেলবেলাটা ভালোই যায়। ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট এনেছিল ওরা। চারজনে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলে। শিশির আর জাহিন এক দল। চপল আর স্বাধীন আরেক দল। জাহিন খুব ভালো পারে না ব্যাডমিন্টন। তার তুলনায় শিশিরই দেখা যাচ্ছে ভালো খেলে।
চপল খেলায় মন দেয়, নতুন কোনো দুষ্টুমি বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটায় না।
দাদি চেয়ারে বসে খেলা দেখেন।
শীতের বিকেল। দ্রুত ফুরিয়ে আসে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে।
ওরা দুপুরেই কেয়ারটেকারকে বলে রেখেছিল বারবিকিউ হবে। মুরগি কিনে আনা হয়েছে। মুরগির প্রসেস করা হচ্ছে। কেয়ারটেকার আর তার সঙ্গে আরেকজন সহকারী রান্নাবান্নার কাজ করছে।
দাদি পেছনে দুহাত বেঁধে পায়চারি করছেন আর রান্নার তদারক করছেন।
মাথার ওপরে ঢেউটিনের ছাদ। উঁচু বড় বারান্দা। ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। তার চারপাশে উড়ছে নানা ধরনের পোকা। ঝিঁঝি ডাকছে। ডাকছে নানা ধরনের পোকা। বিচিত্র ধরনের শব্দ আসছে, একটানা। একটু আগে অনেক পাখি ডাকছিল।
বারবিকিউয়ের জন্য কয়লায় আগুন ধরানো হয়েছে। কেয়ারটেকার আর তার সহকারী বাতাসের জন্য সেখানে ইলেকট্রিক ফ্যান লাগিয়ে দিয়েছে। মাংস ধীরে ধীরে পুড়ছে। খুব সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
শিশির বলে, সামনের শীতে কোথায় থাকব কে জানে।
জাহিন তার পাশেই বসে ছিল।
বলে, সামনের শীতে আপনার কোথায় যাওয়ার কথা?
শিশির বলে, সেটাই তো জানি না। লন্ডনে যেতে পারি ব্যারিস্টারি পড়তে। নিউইয়র্কেও যেতে পারি চাচার ওখানে। আবার দেশেও পড়তে পারি। জানি না।
জাহিন বলে, বাপ রে! এত অপশন! এত অপশন থাকলে তো মাথার চারদিকে চোখ লাগবে।
মানে?
মানে হলো, আপনি যদি ডানে যেতে চান, বাঁয়েও যেতে চান, পেছনেও যেতে চান, তখন চারদিকটা একবারে যাচাই করতে হলে মাথার চারদিকে মোট আটটা চোখ লাগবে।
চপল এসে সেই আড্ডায় ঢুকে পড়ে, আর হতে পারে, ঘাড়ের ওপরে মাথাটা একটা বিয়ারিংয়ের ওপরে বসানো। মাথাটা বনবন করে ঘুরতে পারে। চারদিকে সব দেখতে পায়। হা হা হা…
স্বাধীনও এসে আলাপে যোগ দেয়। বলে, কার্টুন ছবির মতো। মাথা চক্কর খাচ্ছে…
শিশির বলে, কী থেকে আলাপ কোথায় গেল।
জাহিন বলে, গল্পের গরু গাছে ওঠে। আচ্ছা শিশির, ঢাকায় আপনার বাসা কোথায়?
শিশির বলে, উত্তরায়।
জাহিন বলে, আচ্ছা, এয়ারপোর্টের কাছেই। লন্ডনে কিংবা নিউইয়র্কে যেতে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। বাসার কাছে এয়ারপোর্ট থাকা ভালো।
এই সময় সবাই একযোগে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
কেউ কথা বলছে না।
শিশিরের দাদি তখন বলেন, মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে গেলেই কেবল সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যায়!
চপল বলে, মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে গেল! নাকি কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা!
চপল যে হঠাৎ হঠাৎ কী সব কথা বলে!
সবাই আবার নীরব হয়ে যায়।
স্বাভাবিক একটা সন্ধ্যা হঠাৎ অস্বাভাবিক হয়ে আসে। সবাই যেন নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে, এই রকম অস্বাভাবিক নীরবতা!
ওই ওখানে বারবিকিউয়ের চুলায় আগুন জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, তেল পুড়ছে, সেসবের শব্দও কেমন যেন তীব্র।
ঠিক তখনই দূরে ঘন জঙ্গলের ওই কালো কালো অন্ধকার স্তূপের ওই পারে কী যেন নড়ছে।
ইয়া লম্বা সাদা…মনে হচ্ছে কোনো অতিকায় অশরীরী…তার লম্বা হাত লম্বা পা…এক গাছের মাথায় এক পা আরেক গাছের পাতায় আরেক পা।
হঠাৎ দূরে একটা গাছের কাছে দেখা গেল একটা অতি লম্বা সাদা কাপড় দিয়ে বানানো মানবশরীর। বাঁশের ডগায় সাদা কাপড় জড়িয়ে এটা বানানো হয়েছে। দূর থেকে অন্ধকারে দেখতে ভূতের মতো দেখা যাচ্ছে।
কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যাচ্ছে সেদিকে।
কতগুলো বাদুড় একযোগে আকাশে উড়ে ঝাপ্টাতে থাকে পাখা।
সেদিকটায় তাকিয়ে আউ করে চিৎকার করে ওঠে চপল।
স্বাধীনও তাকায় সেদিকটায়। উল্টে পড়ে যায় চেয়ার থেকে।
সবার আগে নিজের রুমের দিকে দৌড় ধরেন দাদি। কোনো কথা না বলে তাঁর পেছন পেছন ছুটতে থাকে শিশির।
পুরো ঘটনা ঘটে চোখের পলকে।
স্বাধীন মাটিতে ঠেস দিয়ে উঠে বসে।
আর জাহিন তার চেয়ারে বসা অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। কেয়ারটেকার দৌড়ে আসে, কী হইছে?
চপল বলে, পানি আনেন তো। জাহিন ছেলেটার মনে হচ্ছে ফিটের ব্যামো আছে। বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে।
কেয়ারটেকার জগে করে পানি আনে। চপল জাহিনের চোখে-মুখে পানি ছিটায়।
কিন্তু জাহিনের জ্ঞান ফেরে না।
চপল বলে, স্বাধীন, আয় তো। ধর একে। রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিই।
চপল আর স্বাধীন পাঁজাকোলা করে ধরে জাহিনকে নিয়ে যায় রুমে।
চপল বলে, এ তো ভারি মুশকিল হলো। এই ব্যাটা না আবার মরে টরে যায়।
স্বাধীন বলে, এখন কী করবি?
চপল বলে, এই রকম ভিতুর ডিমের সঙ্গে আর কোথাও আসব না কোনো দিন।
স্বাধীন বলে, বেঁচে যদি থাকে, তাহলে না আরেকবার আসার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু মরে টরে যদি যায়!
চপল বলে, মরে গেলে খবরই আছে। ভূত হয়ে এসে আমার ঘাড় ভাঙবে সবার আগে।
স্বাধীনের খুব মন খারাপ হয়। তাদেরই তো বন্ধু। এভাবে নিজেদের দুষ্টুমির কারণে জ্ঞান হারিয়ে মরে টরে যাবে, সেটা কি খুব একটা কাজের কথা হলো?
চপল জাহিনের চোখে-মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে।
কোনো লাভ হচ্ছে না।
স্বাধীন বলে, কোথাও কোনো ডাক্তার পাই কি না দেখব?
চপল বলে, হ্যাঁ দেখ। অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
স্বাধীন দ্রুত পায়ে বেরোয় ঘর থেকে। কেয়ারটেকারের কাছে যায়। কামাল ভাই, আশপাশে কোনো ডাক্তার আছে?
কেয়ারটেকার বলেন, ডাক্তার নাই। তয় একজন আছে। মেডিক্যাল কলেজে পড়ে।
স্বাধীনের তখন চিন্তা করার শক্তি নেই, সময়ও নেই। সে বলে, চলেন কামাল ভাই, তার কাছেই যাই। তিনি তো বলতে পারবেন আশপাশে কারও কাছে কোনো হেলপ পাওয়া যাবে কি না!
কেয়ারটেকার বলে, কিন্তু আমার পাকশাক তো শ্যাষ হইল না।
পরে শেষ করবেন। আগে তো মানুষ বাঁচাতে হবে। চলেন।
কেয়ারটেকার আগে আগে যাচ্ছে। পেছন পেছন ছুটছে স্বাধীন।
তখন মুহূর্তেই স্বাধীনের ভয়ডর সব উবে যায়। এই সব জঙ্গলি পায়ে চলা পথ মাড়িয়ে সে ছুটে চলে কেয়ারটেকারের পিছু পিছু।
তার হাতে একটা টর্চলাইট। তার হাতের সঙ্গে টর্চলাইটটা আগুপিছু করছে। আলোটাও দুলছে।
খানিকটা পথ পেরুনোর পরে একটা গাছগাছালি ছাওয়া বাসা চোখে পড়ে।
বাইরে ইলেকট্রিক আলো। কতগুলো আমগাছ লিচুগাছের ফাঁকে ফাঁকে লাইটপোস্ট। টিনের চালের ওপরেও আলো এসে পড়েছে। গ্রিলঘেরা বারান্দা। সাদা দেয়ালের বাসা।
কেয়ারটেকার দরজা ধাক্কায় আর বলে, ডাক্তার আপা আছেন নাকি? ডাক্তার আপা?
স্বাধীন বলে, আপা? লেডি ডাক্তার নাকি?
কেয়ারটেকার বলেন, হ। লেডিস ডাক্তার।
একটু পরে একজন তরুণী বের হয়। হালকা-পাতলা। খুব বেশি লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়। তার চোখে ইয়া বড় চশমা। সে বলে, কী অবস্থা, কালাম ভাই? রাতের বেলা?
স্বাধীন তোতলাতে তোতলাতে বলে, আমাদের একজন ফ্রেন্ড সেন্সলেস হয়ে গেছে। গেস্টহাউসে। আপনাকে একটু আসতে হবে।
তরুণী বলে, আমি তো পুরোপুরি ডাক্তার নই।
স্বাধীন বলে, তাহলে উপায়?
তরুণী বলে, চলেন যাই। আমি ট্রিটমেন্ট করতে পারব না। তবে আপনাদের হয়তো সাহস দিতে পারব। চলেন দেখি।
তরুণী ভেতরে যায়। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
কেয়ারটেকার এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতে চায়। তরুণী রাজি হয় না। তারা দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে থাকে বাংলোর দিকে।
স্বাধীন হাঁপাচ্ছে। সে বলে, আমার নাম স্বাধীন। আমরা তিন বন্ধু বেড়াতে এসেছি এখানে।
ইন্টার্নি ডাক্তার বলে, আচ্ছা।
সে তো আর কিছুই বলছে না। অগত্যা স্বাধীন বলে, আপনার নামটা জানতে পারি?
দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটি বলে, নিশ্চয়ই। আমার নাম নাজনিন।
স্বাধীন বলে, আচ্ছা আচ্ছা। খুব সুন্দর নাম।
কথাটা বোকার মতো শোনায়।
নাজনিন বলে, রোগীর কী অবস্থা? এর আগেও কি সেন্সলেস হওয়ার হিস্ট্রি আছে?
স্বাধীন নিজেকে বুদ্ধিমান বা স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করে, বলে, হিস্ট্রিতে আছে কি না জানি না। জিওগ্রাফিতে তো নাই।
নাজনিন বলে, মানে?
অনেক আগে কখনো অজ্ঞান হয়েছিল কি না জানি না। তবে এর মধ্যে একবার হয়েছে। আমরা ওকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিলাম?
ভূতের ভয়?
হ্যাঁ। মানে আমি আর আমার বন্ধু চপল মিলে ভূত সেজে অন্ধকারে ওকে ভয় দেখাই। তখন ও অজ্ঞান হয়ে যায়। সেটা তো গত রাতের কথা। আজকে আবার হয়েছে।
আজকে কি আবার ভয় দেখিয়েছেন?
হ্যাঁ। বড় বড় ভূত, ইয়া বড় বড় পা, এক গাছে এক পা আরেক গাছে আরেক পা…
এই সব বলে তাকে ভয় দেখিয়েছেন?
কিছু বলে। কিছু অ্যাক্টিং করে। কিছু জিনিসপত্র লাগে, নাটকের প্রপসের মতো…
কাজটা আপনারা ঠিক করেননি। ওনার তো প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে মনে হচ্ছে।
সেটা কী জিনিস?
ওই তো ভয় পাওয়া। কিন্তু প্যানিক অ্যাটাক থেকে বারবার ফেইন্ট হয়ে যাওয়া তো ভালো কথা না।
ডা. নাজনিনকে নিয়ে স্বাধীন গেস্টহাউসে জাহিনের রুমে প্রবেশ করে। জাহিন শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এখনো অচেতন। চপল তার শিয়রের কাছে বসে আছে।
স্বাধীন বলে, চপল, এই যে ডাক্তার আপা এসেছেন। ডাক্তার নাজনিন। খুব ভালো ডাক্তার।
নাজনিন এগিয়ে যায় রোগীর কাছে। প্রথমেই জাহিনের কবজি ধরে। নাড়ি দেখে। তারপর কানে স্টেথোস্কোপ লাগায়। জাহিনের বুক পরীক্ষা করে।
স্বাধীন মনে মনে বলে, আরে জাহিন বজ্জাতটার তো কপাল ভালো। কী রকম যত্ন পাচ্ছে।
নাজনিন বলে, একটু তেল গরম করে আনুন তো।
স্বাধীন দৌড়ায়। বাইরে বারবিকিউ হচ্ছে। সেখানে সে কামালকে বলে, কামাল ভাই, গরম তেল দেন তো?
কামাল বলে, কী তেল?
কী তেল মানে?
সরিষার তেল নাকি সয়াবিন?
মুশকিল তো। সরিষার তেলই দেন।
কতটুকুন লাগবে? এক লিটার নাকি এক ছটাক?
স্বাধীন আবারও মুশকিলে পড়ে। বলে, এক চামচ দেন।
কেয়ারটেকার বলেন, কত বড় চামচ? ভাতের চামচ নাকি চা-চামচ?
আপনি তরকারির চামচে দেন।
কেয়ারটেকার চামচে তেল গরম করে চুলার গনগনে আগুনে। তারপর সেটা দেয় স্বাধীনের হাতে। সেই চামচভরা তেল নিয়ে স্বাধীন এগিয়ে যায়। তাকে সাবধানে পা ফেলতে হয়। চামচ থেকে তেল যেন পড়ে না যায়!
স্বাধীন সেই গরম তেলের চামচ তুলে দেয় নাজনিনের হাতে।
নাজনিন জাহিনের পায়ে তেল ডলে দেয়।
স্বাধীন বিড়বিড় করে, কী কপাল। এই রকম একটা ডাক্তার ম্যাডাম জাহিনের পায়ে তেল মাখছে। আগামীকাল যদি আমি নিজে অজ্ঞান না হয়েছি তো আমি শালা স্বাধীনই না!
আস্তে আস্তে জাহিনের জ্ঞান ফেরে।
জাহিন দেখে তার শিয়রে একটা সুন্দরী মেয়ে।
জাহিন বলে, আমি কোথায়? আপনি কে? আমি কি ভূত-পরির দেশে? আপনি কি পরি?
চপল বলে, ওরে বদের ডিম। চোখে পরি দেখো, না? তুই এখনো ধূলির ধরণিতেই আছিস।
নাজনিন বলে, আপনারা ওকে সাবধানে রাখবেন। আমি একটু ওষুধ লিখে দিই। একটা কাগজ দেন।
ওরা খুঁজে পেতে একটা কাগজ বের করে দেয়।
নাজনিন বলে, রোগীর নাম কী?
জাহিন আহমেদ। চপল বলে।
নাজনিন বলে, এক নম্বর ওষুধ হলো, আপনারা ওনাকে ভয় দেখাবেন না। আপনারা বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন। জাহিন সাহেব, আপনার বন্ধুরা আপনাকে ভয় দেখায়। তারা ভূতের অভিনয় করে। আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য তারা নানা ধরনের জিনিসপাতি ঢাকা থেকে নিয়েই এসেছে। আপনি ভয় পাবেন না। বুঝলেন?
জাহিন বলে, আমাকে ওরা ভয় দেখাচ্ছে? সব অভিনয়!
চপল খিকখিক করে হাসে।
জাহিন বলে, বাচ্চার কান্না আসে কোথা থেকে?
চপল তখন মোবাইল বের করে। তার কাছে আরেকটা মোবাইল আছে। সেটা থেকে এই মোবাইলে কল দিলে রিংটোন হিসেবে বাচ্চা শিশুর কান্না শোনা যায়। এই যে বাচ্চার কান্না?
জাহিন বলে, ভূতগুলো যে নাচল? সেসব?
নাজনিন বলে, আপনারা কী কী দিয়ে ভূত সেজেছেন, জাহিন সাহেবকে দেখান। ওনার ভয় দূর করতে হবে।
চপল বলে, আচ্ছা আমি আনছি কিছু জিনিস। চপল ফোন করে কাদেরকে। কাদের ভাই, গাড়ির পেছন থেকে ওই ভূতের প্রপসগুলো আনেন তো। উল্টা ঠোঙাগুলো আনেন আগে।
কাদের আসে ঠোঙা নিয়ে, এই সব ক্যান আনতে হইব?
চপল বলে, কাদের ভাই, পরেন তো একটা ঠোঙা।
কাদের ঠোঙা পরলে তাকে সত্যি একটা ভূতের মতোই দেখায়।
স্বাধীন আর চপল খিলখিল করে হাসে। তাই দেখে জাহিনও হেসে ফেলে।
নাজনিন বলে, শোনেন জাহিন সাহেব, এই যে আপনার ভূত। আর ভয় পাবেন না।
জাহিন বলে, না না আর ভয় পাব না। থ্যাংক ইউ।
ডাক্তার নাজনিন বিদায় নিচ্ছেন।
স্বাধীন বলে, আপনার ফিস কত?
নাজনিন বলে, না না, ফিস লাগবে না। আমি তো ইন্টার্নি। আমি তো প্র্যাকটিস করতে পারি না।
স্বাধীন বলে, চলেন তাহলে, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
নাজনিন বলে, না না, আমি একাই যেতে পারব।
স্বাধীন বলে, তা তো পারবেনই। কিন্তু আমি তো আপনাকে একা যেতে দেব না।
স্বাধীন আর নাজনিন আবারও সেই একই পথে ফিরে যায় নাজনিনের বাড়ির দিকে।
যেতে যেতে দুজনে গল্প করে।
স্বাধীন বলে, ড. নাজনিন। আপনি পড়াশোনা করেছেন কোন কলেজে।
নাজনিন হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট গাছের পাতা হাতে তুলে নিয়ে বলে, ডিএমসি।
জি?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
ও আচ্ছা। খুব ভালো মেডিকেল কলেজ।
আপনি?
আমি এমবিএ করছি।
আচ্ছা।
তো আপনি ঢাকায় পড়াশোনা করে এখানে কেন?
এখানে এসেছি চা-বাগানের শ্রমিকদের একটা হেলথ প্রোগ্রামে। কিছু রিসার্চ করছি।
আচ্ছা আচ্ছা, ইয়ে মানে আপনার মোবাইল নম্বরটা একটু পেতে পারি? আমাদের ওখানে যা সব কাণ্ড হচ্ছে, আবার কে না কে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন আপনাকে মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে আনা যাবে।
আচ্ছা লিখে নিন.জিরো…
রাতের খাওয়া তাদের ভালোই হলো। বারবিকিউটা ভালো হয়েছে।
শিশির আর দাদিও এসে যোগ দিল ডাইনিং টেবিলে।
চপল বর্ণনা করতে লাগল, কীভাবে তারা জাহিনকে ভয় দেখানোর জিনিসপত্র জোগাড় করেছে, কীভাবে কাদের অভিনয় করেছে। জাহিন বিস্মিত।
চপল আর স্বাধীন হেসেই খুন।
আর শিশির যাচ্ছে রেগে। জাহিন ছেলেটা ভালো। তাকে এভাবে ভয় দেখানোর কী হলো?
রাত ১২টার দিকে চপল ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ সে শুনতে পায়, বাইরে কে যেন করুণ সুরে কাঁদছে।
চপল উঠে পড়ে। ভূতগ্রস্তের মতো সে বাইরে আসে।
কোনো কিছু অস্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে না।
কে কাঁদে।
ওই গাছের নিচে?
সে এগিয়ে যায়?
তখনই কে যেন পেছন থেকে এসে তার ঘাড়ে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে বসে।
চপল পড়ে যায়। এবং জ্ঞান হারায়।
আকাশ অন্ধকার। সব নিশ্চুপ। কয়েকটা ইলেকট্রিক বাতি সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাগানের ঘাসের ওপরে পড়ে আছে চপলের নিঃসাড় দেহ।
৪. জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়
জাহিনের ঘুম ভেঙে যায় কান্নার শব্দে।
কে যেন বাইরে করুণ সুরে কাঁদে। নারী নাকি পুরুষ! নাকি শিশু? এটা কি চপলের মোবাইল ফোনের রিংটোন? চপলের রিংটোনে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় বটে, তবে এই কান্না আর ওই কান্নার শব্দ এক নয়। চপল কই?
চপল আর জাহিন এক রুমে পাশাপাশি সিঙ্গেল বেডে ঘুমায়। জাহিন ভয় পায় বলে ঘরটা পুরো অন্ধকার নয়। এক কোণে একটা বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় জাহিন পাশের বিছানার দিকে তাকায়। চপল কই?
এই চপল। এই…তুই কই? বাথরুমে?
না তো। বাথরুমের দরজা খোলা। ভেতরটা অন্ধকার।
ঘরে কেউ নেই। সে দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা। চপল কই গেছে? এই ছেলেটাকে নিয়ে এত মুশকিল। খালি দুষ্টুমি বুদ্ধি আঁটে। মানুষকে চমকে দিতে চায়। ভড়কে দিতে চায়। এই সব করেই সে আনন্দ পায়।
হঠাৎই বাইরে পায়ের শব্দ। একটা ধপাস আওয়াজ। কেউ কাউকে আঘাত করল। একটা আর্তনাদ। কারও পড়ে যাওয়ার শব্দ। কারও দৌড়ানোর। তারপর নীরবতা।
জাহিন ভয় পাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে, ডাক্তার নাজনিন বলে গেছেন, ভয় পাবেন না। আপনার বন্ধুরা আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য অনেক কিছু আয়োজন করেছেন। অনেক কিছু ঢাকা থেকে এনেছেন।
তার মানে আবারও চপল তাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। না, সে ভয় পাবে না।
কিন্তু ভয় তো লাগছেই। দরজাটা খোলা। এই খোলা দুয়ার দিয়ে যে কেউ তার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। চোর-ডাকাত। ভূত-প্রেত। বাঘ-ভালুক।
সে ওঠে। সুইচ টিপে দুটো বাতি জ্বালায়।
ঘরটা আলোয় আলোয় ভরে ওঠে।
সে আস্তে আস্তে বারান্দায় যায়। পাশের ঘরটা স্বাধীনের। স্বাধীন কি ঘরে আছে? নাকি সেও বেরিয়ে গেছে চপলের সঙ্গে? নাকি তারা দুজনেই এই ঘরে বসে কোনো ষড়যন্ত্র করছে?
সে স্বাধীনের দরজায় নক করে। স্বাধীন স্বাধীন।
স্বাধীন ঘুম থেকে জাগে। কে? সে ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলে।
আমি জাহিন। দোস্ত, দরজাটা একটু খোল।
স্বাধীন দরজা খোলে, কী হয়েছে?
চপল কই?
তোর ঘরে।
না ঘরে নাই।
তাহলে।
জানি না। বাইরে কিসের যেন শব্দ হলো। মনে হলো, কেউ কাউকে আঘাত করল। আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি, চপল নাই।
স্বাধীন বলল, এই চপলটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। চল তো দেখি। সে চপ্পলে পা গলিয়ে টর্চলাইট তুলে নিয়ে বেরোল ঘর থেকে। জাহিনদের ঘরে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারল। বাথরুম চেক করল।
তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, চপল চপল।
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
তারা দুজন বাইরের বারান্দায় এল। এখান থেকে গেস্টহাউসটার আঙিনা দেখা যায়।
দেখল, আঙিনায় কে যেন পড়ে আছে।
তারা দুজনে দৌড়ে গেল মানবশরীরটার কাছে।
স্বাধীন টর্চের আলো ফেলল তার মুখে। এ তো চপলই।
তারা দুজনে মিলে চপলের শরীরটা ধরে টেনে নিয়ে এল ঘরে।
স্বাধীন গ্লাসে করে পানি এনে ছিটা দিতে লাগল চপলের মুখে।
খানিক পরে চপল চোখ মেলে তাকাল।
স্বাধীন বলল, এখন একটু ভালো লাগছে?
চপল বলল, আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম?
স্বাধীন বলল, হ্যাঁ। বাইরের লনে পড়ে ছিলি। ভাগ্যিস জাহিন সাহস করে আমাকে ডেকে তুলেছিল।
বাইরে গিয়েছিলি কেন?
চপল উঠে বসল। বলল, ঘাড়ে মেরেছে। ব্যাটা মনে হচ্ছে প্রশিক্ষিত। এক মারেই আমাকে কুপোকাত করে ফেলল।
জাহিন বলল, ব্যাটাটা কে?
চপল বলল, জানি না। বাগানবাড়িটা তো সত্যি রহস্যজনক হয়ে উঠল।
স্বাধীন বলল, কথা বলিস না। শুয়ে থাক। রেস্ট নে। খুব ব্যথা করছে ঘাড়ে? ডাক্তার নাজনিনকে ডাকতে যাব?
চপল বলল, তোর খুব ইচ্ছা করছে ডাক্তার নাজনিনের কাছে যেতে, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু দরকার হবে না। আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমাকে কে অ্যাটাক করল? এটা তো জানা দরকার।
স্বাধীন বলল, এখন ঘুমাই। কালকে রহস্যের কিনারা করা যাবে। কী বলিস?
জাহিন বলল, সেই ভালো। স্বাধীন, তুইও আমাদের ঘরে চলে আয়। আমরা ডাবলিং করি। তিনজনে একসঙ্গে থাকলে ভয় কম লাগবে।
স্বাধীন বলল, আচ্ছা আমি বালিশ নিয়ে আসছি।
*
রাতে চপলের ভালো করে ঘুম হলো না। ঘাড়ে ব্যথা করছে। সেটাও খুব বড় কথা নয়? তাকে আঘাতটা কে করল? এর আগে পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, সবটাই ঘটেছে তার জানাশোনার ভেতরে। তার পরিকল্পনামাফিক। শুধু ওই ইংরেজি-বলা ভিক্ষুকটিকে সে চেনে না। নয়তো, সবটাই তো সাজানো। এই যে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল, ঢিল পড়ল, শিশুকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ, বড় বড় ভূতের ছায়া—এসবই সে আর কাদের মিলে আয়োজন করেছে। স্বাধীনও সহযোগিতা করেছে।
কিন্তু কাল দুপুরে জানালার কাছে এসেছিল কে?
আর আজ রাতে কান্নার আওয়াজটাই বা এল কোত্থেকে? আর তাকে আঘাত করে বসল কে?
ভাবতে ভাবতে চপল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল নারীকণ্ঠের গানের আওয়াজে।
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…
আধো ঘুমে, আধো জাগরণে চপল ভাবতে লাগল, কে গান গায়?
শিশির?
একটু পরে সে বুঝতে পারল, পাশের ঘরে কেউ গান বাজাচ্ছে।
গানটা খালি গলায় হচ্ছে। কোনোরকমের মিউজিক ছাড়া।
চপল উঠে পড়ল বিছানা থেকে। পাশের বেডে জাহিন আর স্বাধীন বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছে। সে বলল, এই তোরা ওঠ।
জাহিন আর স্বাধীনেরও ঘুম ভেঙে গেল।
চপল বলল, কী সুন্দর গান বাজছে। মন দিয়ে শোন গানের কথাগুলো। এই গানটা শুনলে আমার ভেতরটা যেন কেমন করে ওঠে।
তারা কান পেতে গানের কথা শুনতে লাগল:
‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে\
পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া—
সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি—
নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে\
বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কী কারণে?
চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারী,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে\’
গান শেষ হলে চপল বলল, গানের কথা সুন্দর না। চারদিকে কত আলো, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, এর মধ্যে আপনমনে নিজের ক্ষুদ্র দুঃখ নিয়ে বসে থাকলে চলবে? ওঠ ওঠ।
জাহিন বলল, শিশির কি পাশের ঘরে এই গান গাইছে নাকি?
চপল বলল, আমার মনে হয়, গানটা সিডি প্লেয়ারে বা মোবাইল ফোনে বাজছে।
স্বাধীন বলল, এই গান শুনে আমার মনটাও যেন কেমন কেমন করছে।
চপল বলল, কেমন কেমনটা কেমন?
স্বাধীন বলল, ওই যে গানের মধ্যে আছে না লাইনটা, ‘প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে’, ওই লাইনটা শুনে নিজের জীবনটাকে মনে হচ্ছে একটা বিশাল শূন্য।
চপল হাসতে লাগল হো হো করে।
কাল রাতে সে যে মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল বাইরে খোলা আকাশের নিচে, তাকে দেখে কে বলবে?
জাহিন হাতমুখ ধুয়ে গেল শিশিরের ঘরের দিকে। ভেতর থেকে একটার পর একটা রবীন্দ্রসংগীতের ধ্বনি ভেসে আসছে।
বাইরে থেকে দরজা বন্ধ, কিছুই করার নেই। সে আবার ফিরে এল বন্ধুদের কাছে।
তারপর সবাই মিলে বসল নাশতার টেবিলে।
কেয়ারটেকার আর তার সহকারী নাশতার টেবিল সাজাচ্ছে।
ব্রেড, বাটার, জ্যাম-জেলি। ডিম পোচ। চা।
দাদিকে সঙ্গে নিয়ে শিশিরও এল। তবে একটু দেরিতে। জাহিন উসখুস করছিল। শিশিরকে দেখে তার মুখটা একটা প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল।
সে বলল, সকালবেলা খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছিল আপনাদের রুম থেকে। আমি তো ভেবেছিলাম শিশির নিজেই গাইছেন।
শিশির বলল, হ্যাঁ গাইছিলাম তো!
জাহিন মুগ্ধ ও বিস্মিত। আপনি গাইছিলেন? দ্যাখ চপল, গানগুলো শিশিরই গাইছিলেন। চপল ভেবেছিল, সিডি প্লেয়ারে বাজছে।
শিশির বলল, সিডি প্লেয়ারেই বাজছিল।
জাহিন বলল, আপনি না বললেন আপনি গাইছিলেন?
শিশির বলল, আমি গাইছিলাম। আর সিডি প্লেয়ারেই সেসব বাজছিল।
জাহিন চোখে-মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে বলল, কথাটার মানে বুঝলাম না। রসিকতা করছেন বোধ হয়। সেটাও ধরতে পারছি না।
শিশির বলল, না না। রসিকতা না। আমি কতগুলো রবীন্দ্রসংগীত খালি গলায় রেকর্ড করে রেখেছিলাম। সকালবেলা তা-ই বাজাচ্ছিলাম।
জাহিন এবার অভিভূত। বলল, বাহ্! বাহ্! কী সুন্দর গলা! আর কী সুন্দর গায়কি। আমরা সবাই আপনার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আজ রাতে আপনার রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসাব, আপনি যদি রাজি থাকেন।
স্বাধীন বলল, শ্রোতা হিসেবে আমাদের ডাক্তার আপাকেও ডাকা যেতে পারে। তিনি যদি রাজি থাকেন।
চপল বলল, দাদি, আমরা তিন বন্ধু। এর মধ্যে জাহিন দেখা যাচ্ছে আপনার নাতনির রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। তার ওপর সে বোটানির ছাত্র। গাছপালা চেনে। আপনার নাতনিও দেখা যাচ্ছে বৃক্ষপ্রেমিক। ভালোই মিলেছে। এই দিকে এক ডাক্তার আপাকে পাওয়া গেছে। আমার আরেক বন্ধু স্বাধীন তাকে আনা-নেওয়া করার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। শুধু আমারই এই সব বিষয়ে কোনো আগ্রহ নাই।
শিশির বলল, আপনার তো ভূত-পেতনির ব্যাপারে আগ্রহ। কী করে মানুষকে ভয় দেখানো যায়, এই নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন। চিন্তা করবেন না। আপনার কপালে একটা পেতনি ঠিকই জুটে যাবে।
দাদি বললেন, এখানে আমরা আছিই পাঁচজন। শিশির আর জাহিন বোটানি নিয়ে কথা বলুক। স্বাধীনের আগ্রহ থাকুক ডাক্তারি নিয়ে। আমি তো আসলে একটা জিন্দা লাশ। আমি তোমার সঙ্গে আছি, চপল। চলো, আমরা দুজন আজকে জঙ্গল দেখতে বের হই। ভেতরে নাকি একটা ঝরনা আছে, সেই ঝরনার ধারে দুজনে বেড়িয়ে আসি।
দাদি এমন গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল যে, তার কথা শেষ হলে সবাই হেসে উঠল খিলখিল করে।
স্বাধীন চা খেতে খেতে একটা আইডিয়া বের করে ফেলে। চপল তো সবাইকে বোকা বানায়, এবার সে চপলকেই খানিকটা বোকা বানাবে। সে ডাকে জাহিনকে।
জাহিন, জাহিন, শোন, এদিকে আয়। আয়, চপলকে বোকা বানাই।
জাহিন বারান্দার চেয়ারে বসে উঠোনের একটা কাঠবিড়ালির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, কী রকম?
স্বাধীন বলে, আমি ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করব। তুই কেবল জানবি যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাইনি। এই যে ডাক্তার নাজনিনের মোবাইল ফোনের নম্বর। তুই ডাক্তার নাজনিনকে ডেকে আনবি।
তারপর?
ডাক্তার নাজনিন আমার হাতে-পায়ে গরম তেল মেখে দেবেন।
বাহ্। তাতে চপল বোকা বনবে কেন?
আরে চপল ভাববে, আমি সত্যিকারের অজ্ঞান হয়েছি। আমার পায়ে যতই তেল মাখুক, আমি তো আর জাগব না।
তখন চপল খুব ভয় পেয়ে যাবে। তখনই আমি হাসতে হাসতে উঠে বসব।
নট আ ব্যাড আইডিয়া, জাহিন বলে।
স্বাধীন আর জাহিন বসেছিল বারান্দায়। চপল গোসল সেরে বাইরে বেরিয়েছে। একা একা গান গাইছে। হঠাৎই স্বাধীন চিৎকার করে উঠল, ওরে বাবারে ওটা কী রে!
তারপর ধপাস করে পড়ে গেল বাইরের বেতের চেয়ারের ওপারে। সেখান থেকে শব্দ করে পড়ে গেল কাঠের মেঝেতে। শব্দটা একটু বেশিই জোরে হলো।
জাহিন নিজেই ভড়কে গেছে। এটা যে অভিনয়, সেটা সে ভুলেই গেছে। সে আর্তনাদ করে উঠল। তার বুক ধড়াস ধড়াস করে কাঁপছে।
তার চিৎকার শুনে দৌড়ে এল চপল। এই, কী হয়েছে?
জাহিন কথা বলতে পারছে না। ভয়ে তার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে। শুধু ডান হাতের তর্জনী দিয়ে সে দেখিয়ে দিল স্বাধীনকে। স্বাধীন মেঝেতে পড়ে আছে চিত হয়ে। মুখটা একদিকে কাত করা। মুখের কোনায় ফেনা।
চপল বলল, এ তো যন্ত্রণা হলো। তুই দুবার জ্ঞান হারালি। আমি একবার। স্বাধীনটা বাকি ছিল। সেও হারাল। তাও এই দিনের বেলা। ধর। ওকে বড় সোফাটায় আগে শোয়াই।
জাহিন আর চপল মিলে ধরে স্বাধীনকে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দিল।
কেয়ারটেকার দৌড়ে এসেছেন। চপল বলল, কামাল ভাই, একটু তেল গরম করে আনেন তো! ডাক্তার নাজনিনের চিকিৎসাপদ্ধতি অ্যাপ্লাই করি।
কেয়ারটেকার দৌড় ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলায় তেল গরম করতে।
চপল বলল, জাহিন, যা পানি নিয়ে আয় এক গ্লাস। ওর চোখে-মুখে পানি ছিটাই।
স্বাধীন চোখ বন্ধ করে আছে। অজ্ঞানের অভিনয় করা বড়ই কঠিন। পায়ের কাছটা চুলকাচ্ছে। কিন্তু সে সেখানে চুলকাতে পারছে না।
চপল তার চোখে-মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে। পানির ছিটা সহ্য করাও কঠিন। তার নাক ভ্রু কুঁচকে আসছে পানির ছিটায়। কিন্তু তার মুখও স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে।
সে মনে মনে রেগে যাচ্ছে জাহিনের ওপরে। জাহিনের কর্তব্য ডাক্তার নাজনিনকে ফোন করে ডেকে আনা। বদমাশটা সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে। আরে তুই যখন জ্ঞান হারালি, তখন তোর জন্য কি আমি ডাক্তার ডাকতে ছুটে যাইনি? অকৃতজ্ঞ পামর কোথাকার! তোর চিকিৎসা করল ডাক্তার নাজনিন, আর আমার চিকিৎসা করছে চপল। এই কি কথা ছিল?
গরম তেল এসে গেছে। কেয়ারটেকার নিয়ে এসেছেন।
চপল বলল, কামাল ভাই, আপনি একটু ওর পায়ে তেলটা মেখে দিন না!
স্বাধীন প্রমাদ গুনল। এই ছিল তার কপালে। একেই বলে অদৃষ্ট। জাহিন যখন অজ্ঞান হলো, তখন তার হাতে-পায়ে তেল মেখে দিল একজন তরুণী। আর সে যখন অজ্ঞান হওয়ার ভান করছে, তখন কিনা কেয়ারটেকারের রান্না করা পোড়া খসখসে হাতের ওপরে পড়ল সেই ভার। সে কি এখনই উঠে জাহিনকে একটা গদ্দা মারবে ঘাড়ে?
কেয়ারটেকার পায়ে গরম সরষের তেল মেখেই চলেছেন। এমন জোরে জোরে ঘষা দিচ্ছেন যেন স্বাধীনের পা ক্ষয়ে যাবে। হাত তো নয়, যেন সিরিঞ্জ কাগজ।
যতই মাখো না কেন বাবা, আমি উঠছি না। ডাক্তার নাজনিনের প্রশিক্ষিত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বাধীন জাগবেই না।
চপল বলল, দুশ্চিন্তার মধ্যেই তো পড়া গেল। এর জ্ঞান তো ফিরছে না!
তখন হুঁশ হলো জাহিনের। আরে তাই তো। তার তো ডাক্তার নাজনিনকে ডেকে আনার কথা!
সে মোবাইল ফোন তুলে কল করল নাজনিনের নম্বরে।
হ্যালো, ডাক্তার নাজনিন বলছেন, আমরা ওই গেস্টহাউস থেকে। আমাদের বন্ধু স্বাধীন সেন্সলেস হয়ে গেছে। আপনি একটু আসবেন। প্লিজ প্লিজ…
আচ্ছা আসছি, নাজনিনের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলো জাহিন।
ডাক্তার নাজনিন এলেন।
চপল বলল, বড়ই টেনশন হচ্ছে। চোখে-মুখে পানি দিয়েছি। হাতে-পায়ে সরষের তেল মাখা হয়েছে। তবু তো ওর জ্ঞান ফিরছে না।
নাজনিন বললেন, আচ্ছা। আরেকটা উপায় আছে। কারও নোংরা মোজা আছে? দুর্গন্ধওয়ালা!
চপল বলল, আমার কালকের মোজা তো ধোয়া হয়নি। ওতে চলবে।
নাজনিন বললেন, চলতে পারে। বা জুতার সুকতলি। সেটা শুকানো যেতে পারে।
চপল মহা-উৎসাহে ছুটল নিজের জুতার মোজা আনতে।
কাদের মৃধাকেও দেখা গেল তার স্যান্ডেল হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে। কাদের বলল, আমার স্যান্ডেলের মতো বদ গন্ধ আর কারও স্যান্ডেলেই হইত না। এইটা নাকে ধরলে মিরগি রুগী খাড়া হইবই।
চপল এল তার আধোয়া মোজা নিয়ে। কাদের এল তার স্যান্ডেল নিয়ে।
এই সব এখন ধরা হবে স্বাধীনের নাকে। এই গন্ধ শুঁকলে নাকি মৃগী রোগী জাগবেই।
স্বাধীন প্রমাদ গুনল। এই ছিল তার কপালে? বড় আশা করে সে জ্ঞান হারানোর অভিনয়ে নেমেছিল। নাজনিন তার হাতে-পায়ে তেল ডলে দেবে! মানুষ আশা করে এক আর হয় আরেক।
কাদেরের স্যান্ডেল তার মুখের সামনে।
সে ওয়াক করে উঠল।
তারপর আর অভিনয় করার মানে হয় না।
চপল তার নাকের সামনে মোজা ধরতেই সে তার গালে কষে মারল এক চড়।
হারামজাদা, জাহিন অজ্ঞান হলে ডাক্তার আপাকে দিয়ে সেবা করো আর আমি অজ্ঞান হলে নাকের কাছে গন্ধওয়ালা মোজা ধরো না?
চপল এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে এর সবই ছিল অভিনয়। সে হা হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, ডাক্তার নাজনিন, আপনার পেশেন্ট আপনার শুশ্রূষা চায়। হা হা হা…
নাজনিন ব্যাপারটা খানিকটা বুঝলেন বলেই মনে হলো। তাদের শিক্ষকেরা ক্লাসে নানা ধরনের রোগীর নানা ধরনের আবদার-যন্ত্রণা-মানসিকতা নিয়ে অনেক গল্প করেছেন। এর মধ্যে একটা কথা হলো, ডাক্তার নারী হলে পুরুষ রোগী অনেক সময় বানিয়ে বানিয়ে রোগের গল্প শোনায়। বারবার আসে।
নাজনিন বললেন, স্বাধীন সাহেবের তো মনে হচ্ছে জটিল অসুখ। তাঁকে একটা ইনজেকশন দিতে হবে। নিডলটা একটু মোটা। এখানে আবার চিকন সুচ পাওয়া যায় না। গরু-ছাগলকে ইনজেকশন দেবার একটা সিরিঞ্জ পাওয়া গেছে। স্বাধীন সাহেব, আপনাকে ওই ইনজেকশনটাই এখন দেওয়া হবে।
স্বাধীন বলে, আরে আমার কিছু হয় নাই। চপলকে একটু ঘাবড়ে দিলাম আরকি! ও সবাইকে ভয় দেখায়। এবার আমরা ওকে একটু বোকা বানালাম। আপনি এসেছেন। আপনাকে দেখেই আমার সব রোগ সেরে গেছে। আপনি বসেন। আপনাকে এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াই। আমি একেবারে কাপাচিনো বানিয়ে খাওয়াব আপনাকে। এখানকার খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে। আমি ঢাকা থেকে সব উপকরণ নিয়ে এসেছি।
আচ্ছা খাওয়ান দেখি আপনার কাপাচিনো।
এর মধ্যে দাদি আর শিশিরও এসে গেছে বারান্দায়। স্বাধীন কফি বানাচ্ছে। দুধ দিয়ে ভালো করে ঘুঁটা দিয়ে তার ওপরে চকলেটের গুঁড়া ছিটিয়ে সে বানাল কাপাচিনো।
মোট ছয় কাপ।
সেই কাপে চুমুক দিয়ে নাজনিন সত্যি বিমোহিত—উম্ম্, দারুণ!
চপল বলল, স্বাধীন। তুই তো দারুণ কফি বানানো শিখে গেছিস। তবে তোর এই প্রতিভা এত দিন চাপা দেওয়াই ছিল। আজকে জুতার আর মোজার গন্ধে সেটা জেগে উঠেছে। এর পর থেকে তোকে দুবেলা জুতা শোঁকানো হবে।
স্বাধীন ওয়াক করে উঠল।
কিন্তু ঘটনা নিরীহ হাসিঠাট্টার মধ্যে সীমিত রইল না।
সন্ধ্যার সময়ে রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসেছে।
উঠোনের এক কোণে বারবিকিউ হচ্ছে। আগুন জ্বলছে। বেশ আরামদায়ক ঠান্ডা।
আরেক পাশে গার্ডেন চেয়ার নিয়ে বসে আছে সবাই।
গোল হয়ে।
শিশির রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করল।
‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…’
জাহিনের মনে হতে লাগল, এই গান যেন শিশির তার উদ্দেশেই গাইছে।
‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে\’
গানের শেষে দাদি বললেন, রবীন্দ্রনাথের গানের সব সময় একাধিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। সব বড় কবি সাহিত্যিকদের বেলাতেই এটা সত্য। তাঁরা যা লেখেন, তাকে একেকজন একেকভাবে দেখতে পারে। বুঝতে পারে। যেমন এই গানটা শুনলে মনে হয় এটা প্রেমের গান। কিন্তু এইটাকে আবার পূজার গানও ধরা যায়। এটা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের উদ্দেশে গেয়েছেন।
জাহিন মনে মনে বলল, চাবি ভেঙে ঘর থেকে বের করে নেবার কথা রবীন্দ্রনাথ কেন ঈশ্বরকে বলতে যাবেন। এটা নিশ্চয়ই শিশির আমার উদ্দেশেই বলছে।
শিশির গান গেয়েই যাচ্ছে একের পর এক। গান শুনে জাহিনের চোখ দিয়ে জলও এল।
শিশির গাইছে:
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?’
এই কথা শুনলে চোখে জল না এসে পারে? তাই তো। কেন মাঝে মাঝে সে তার দেখা পাবে। কেন চিরদিন পাবে না?
দাদি একটু উঠছিল। বারবিকিউয়ের আগুনটা উসকে দিতে।
তারপর সে আগুনেরও ওই পাড়ে যে দোলনাটা আছে, সেটায় বসেছিল।
ও পাশটা একটু অন্ধকারও।
হঠাৎই একটা ভালুকের মতো কালো রোমশ অন্ধকার কিছু একটা, একটা প্রাণী বা মানুষ বা অতিপ্রাকৃত কোনো কিছু, তার পেছনের জঙ্গল থেকে চলে এল তার পেছনে।
এপাশ থেকে বসে গান শুনতে শুনতে চপল চিৎকার করে উঠল, দাদি, সরে যান।
সে দৌড় ধরল সেই প্রাণীটার দিকে।
সবাই সেদিকে তাকাল।
ওই ভালুকের মতো প্রাণীটা জাপটে ধরল দাদিকে।
তারপর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে লাগল জঙ্গলের দিকে।
চপল ছুটছে। পেছনে পেছনে ছুটছে স্বাধীন।
শিশিরও ছুটছে ওই জঙ্গলের দিকে।
শিশিরকে ছুটতে দেখে জাহিনের পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হলো না। সেও ছুটতে লাগল শিশিরের পেছনে পেছনে।
কেয়ারটেকার কামাল একটা আস্ত জ্বলন্ত কাঠের টুকরা হাতে ছুটছে পেছনে পেছনে।
ওই প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে জঙ্গলে।
তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে না দাদিকেও।
টর্চলাইট আনা হলো।
একটা চার্জার লাইট ছিল। সেটাও।
একটু পরে হাজির হলো কাদেরও।
কী হইছে?
চপল বলল, কাদের ভাই, দাদিকে কে যেন ধরে নিয়ে গেছে।
কাদেরও খুঁজতে লাগল জঙ্গলের ভেতরে।
কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা দুজন দুজন করে তিন দিকে খুঁজতে লাগল।
কাদের আর জাহিন একদিকে।
কেয়ারটেকার আর স্বাধীন একদিকে।
চপল আর শিশির আরেক দিকে।
শিশির কাঁদছে। দাদি দাদি বলে।
চপল বলল, শিশির, কাঁদবেন না। আমি বেঁচে থাকতে আপনার দাদির কোনো ক্ষতি করতে দেব না।
একটা ক্লু খুঁজে পেল চপল। দাদির গায়ের চাদর লটকে আছে একটা কাঁটাগাছের ডালে। ছোট্ট একটা কাঁটার ঝোপ।
তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটু সরু পায়ে চলা পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তাটা তিন দিকে বেঁকে গেল। এখন কোন দিকে যাবে চপল?
ওরা একটা রাস্তা ধরল।
রাস্তা ফিরে এল তাদের গেস্টহাউসেই।
সবাই ফিরে এল একে একে।
না। দাদিকে পাওয়া গেল না।
কাঁদতে কাঁদতে শিশিরের অবস্থা খারাপ। সে বলল, আমার তো ঢাকায় জানাতে হবে। আমি কী বলব?
সবাই বারান্দায় গোল হয়ে বসে আছে।
কিছু একটা তো করতেই হবে।
ওই বনের মধ্যে হঠাৎই আগুন জ্বলে উঠল।
আকাশ উঁচু আগুন। আবার নিভেও গেল সেই আগুন।
তারপর বিদ্যুৎ গেল চলে। পুরো গেস্টহাউস অন্ধকার।
আর ঢিল পড়তে লাগল টিনের চালে। ধপধপ করে।
বাইরে কিসের যেন শব্দ। কুকুর ডাকছে। শিয়াল ডাকছে। চারদিকে গাছে গাছে বাদুড় পাখা ঝাপটাচ্ছে। পাখিরা উড়ে উঠছে।
ভয়ে জাহিন অজ্ঞানপ্রায়।
সে বলল, আমি আর এইখানে এক মুহূর্ত থাকব না। আজ রাতেই চলে যাব এখান থেকে। কাদের ভাই। গাড়ি বের করেন।
শিশির বলল, আমি তো দাদিকে ছাড়া যেতে পারব না।
জাহিন বলল, শিশির না গেলে অবশ্য আমারও যাওয়াটা উচিত হবে না।
স্বাধীন বলল, ডাক্তার নাজনিনকে খবর দেওয়া দরকার।
চপল বলল, নাজনিন কী করবে এখানে?
উনি এখানে থাকেন। তাঁর পরামর্শ কাজে লাগতে পারে।
স্বাধীন বলল, পুলিশকে জানানো দরকার। আমি ঢাকায় ফোন করছি। আমার সংবাদপত্র অফিসে। এখানে নিশ্চয়ই কোনো সংবাদদাতা আছে আমাদের কাগজের। তাকে দিয়ে থানাকে জানাই। থানা থেকে পুলিশ আসুক। আজ রাতেই পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেললে নিশ্চয়ই দাদিকে পাওয়া যাবে।
শিশির বলল, তাই করুন। আমি ঢাকায় খবর দেব কি না, বুঝছি না। সবাই তো খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।
স্বাধীন বারান্দায় পায়চারি করছে। তার কানে ফোন।
সে ফোন করছে ঢাকার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকায়। এই পত্রিকায় সে পার্টটাইম অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করে।
ক্রাইম রিপোর্টার কামরুল হাসানের ফোনে ঢুকল সে। কামরুল ভাই, বড় বিপদে পড়েছি। আমরা এসেছি…
এই সময় কোত্থেকে একটা কলাগাছের ইয়া বড় টুকরা এসে পড়ল তার পিঠে।
স্বাধীন ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।
ওই ওখানে?
চপল জঙ্গলের দিকে টর্চ মারল। জঙ্গলটা নড়ে উঠছে।
সবাই দৌড় ধরল জঙ্গলের ওই দিকটা লক্ষ করে।
শিশির এগিয়ে গেল স্বাধীনের দিকে।
মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে স্বাধীন।
তারপর সে তাকে ধরে চিত করল।
ঠোঁটের কাছ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে…
নাহ্। আবারও পাওয়া গেল না আগন্তুককে।
সে দ্রুতই কেটে পড়েছে।
এখানে থাকা আর নিরাপদ হবে না।
চপল ঘোষণা করল।
তার আগে স্বাধীনকে সুস্থ করে তুলতে হবে।
শিশির বলল, আমি দাদিকে না নিয়ে ফিরছি না। আমি ঢাকাতে মুখ দেখাব কী করে?
হঠাৎ চপল বলে ফেলল, আমার মনে হয় আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। আমি জানি।
সবাই আসো আমার সাথে।
৫. দাদি কোথায় আছে
চপল জোর গলায় বলল, আবারও, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। সবাই চলো আমার সঙ্গে।’
স্বাধীন বলল, ‘আমার ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। আগে একটু ডাক্তার নাজনিনকে খবর দিলে হতো না?’
শিশির বলল, ‘না না, আগে দাদিকে উদ্ধার করতে হবে।’
চপল বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই। দাদিকে আগে উদ্ধার করতে হবে।’
শিশির বলল, ‘দাদি কোথায় আছে, আপনি জানেন বলছিলেন। কোথায় আছে?’
চপল বলল, ‘ফলো মি। কাদের, তুমি আমার আগে আগে চলো।’
কাদের বলল, ‘চলেন। কোন দিকে যাব?’
‘তোমার ঘরের দিকে। ড্রাইভার’স কোয়ার্টার’—চপল বলল আদেশের সুরে।
‘চলেন’—কাদের আগে আগে যায়। পেছনে সবাই চলেছে একে একে। স্বাধীন বলল, আমি তো নড়তেই পারছি না। তোমরা যাও। আমি বরং ডাক্তার নাজনিনকে ফোন করি।
স্বাধীন গেস্টহাউসের দিকে এগোতে লাগল। মোবাইল ফোনে সে ডাক্তার নাজনিনের নম্বর খুঁজছে।
ড্রাইভারদের থাকার রুমটা পশ্চিম কোণে। চপলের হাতে টর্চলাইট। সে চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে। বলা যায় না, কোথা থেকে কে এসে আঘাত করে বসে কাকে।
ইটের দেয়ালের ওপরে ঢেউটিন। দুই রুমের একটা বাড়ি।
চপল বলল, কাদের, দরজা খোলো।
কাদের দরজা খুলল।
‘লাইট জ্বালো।’
ঘরে একটাই তক্তপোষ। আর কোনো আসবাব নেই। তার নিচে টর্চ ফেলে দেখল চপল।
শিশির আর জাহিন বাইরে। তারা নজর রাখছে পাশের ঘরটায়।
চপল বলল, ‘কাদের, এবার পাশের ঘরে চলো।’
পাশের ঘরে থাকে কেয়ারটেকার কামাল। দরজাটা বাইরে থেকে ভাঁজ করা ছিল। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, এই ঘরেও কেউ নেই।
চপল হতাশমুখে বেরিয়ে এল। কাদেরের মুখে হাসি। বাইরের বাঁশের খুঁটির ওপরে ঝোলানো বিদ্যুৎবাতির আলোয় শিশির স্পষ্ট দেখতে পেল।
শিশির বলল, দাদি কোথায়?
চপল বলল, পাওয়া গেল না। তবে যাবে।
কাদের বলল, আজাইরা এতক্ষণ খাটাখাটি হইল। আপনেরা কি আমারে সন্দেহ করেন?
চপল বলল, মোটেও না।
ডাক্তার নাজনিন চলে এসেছে। স্বাধীনের ঠোঁট থেকে তখনো রক্ত বের হচ্ছে। নাজনিন তুলোয় ডেটল ভিজিয়ে নিয়ে স্বাধীনের ঠোঁট মুছে দিল।
স্বাধীনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরছে।
নাজনিন বলল, কী হলো? কাঁদছেন কেন?
স্বাধীন বলল, কই, কাঁদছি না তো। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে—এবার সে হেঁচকি দিয়ে উঠল। কান্না গোপন করতে পারছে না।
নাজনিন বলল, কী হলো?
স্বাধীন বলল, আপনি এত ভালো কেন? আপনি এত ভালো কেন?
নাজনিন বলল, ওরা সবাই কই?
স্বাধীন বলল, শিশিরের দাদিকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই তাকে খুঁজতে গেছে।
নাজনিন বলল, কী সর্বনেশে কথা! তো আপনি গেলেন না?
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আমার জন্য? কেন?’
‘আপনি ডাক্তার। আমি রোগী। তাই না?’
‘হ্যাঁ। আমি ডাক্তার বটে। তবে আপনি কি রোগী?’
‘রোগী না! দেখুন ঠোঁট কেটে গেছে। ঘাড়ের পেছনেও খুব আঘাত লেগেছে।’
‘দেখি কোথায়?’
‘না। না। দেখতে হবে না। ঘরে কেউ নেই।’
‘আরে আমি ডাক্তার না? আপনি রোগী না?’
এই সময় বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। চপলদের দল ফিরে এসেছে।
বারান্দার লম্বা বেঞ্চটায় বসে পড়ল শিশির। তারপর গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল।
চপল বলল, স্বাধীন, তুই আবার ঢাকায় ফোন কর তো! পুলিশের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা গেছে? পুলিশ কখন আসবে?
স্বাধীন বলল, আহা রে। আমি একজন রোগী। ডাক্তারের চিকিৎসাধীন আছি। আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার কি এটা সময়?
চপল হাসল। তুই তো ছিলি স্বাধীন। এখন হয়েছিস চিকিৎ স্বাধীন।
মানে? স্বাধীন জানতে চাইল।
তুই বললি না, চিকিৎসাধীন। আজ থেকে তোকে আমরা ডাকব চিকিৎ স্বাধীন বলে। সংক্ষেপে চিকা স্বাধীনও বলতে পারি।
শিশির বলল, এই চপল ভাই, আমার দাদিকে না খুঁজে আপনি ইয়ার্কি-ফাজলামো করেই চলেছেন। নিশ্চয় আপনিই লুকিয়ে রেখেছেন।
চপল বলল, না না, আমি লুকিয়ে রাখিনি। ব্যাপারটা আমার জানাশোনার বাইরে হচ্ছে।
শিশির বলল, তাহলে আপনি কেন বললেন, চলো সবাই, আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। নিশ্চয়ই আপনিই লুকিয়ে রেখেছেন।
চপল বলল, আমি লুকিয়ে রাখিনি। আমি জানিও না দাদিকে কে বা কারা লুকিয়ে রেখেছে। আমি একটা অনুমান করেছিলাম। সেটা ঠিক হয়নি। এখন পুলিশের হেল্প ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এই স্বাধীন আবার ফোন দে।
স্বাধীন মোবাইল ফোন থেকে আবার ফোন করল তার ঢাকা অফিসের সাংবাদিক কামরুল হাসানকে।
হ্যালো, কামরুল ভাই, কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন?
ওপাশ থেকে কামরুল হাসান বললেন, জি ভাইজান, পুলিশ আর তিন মিনিটের মধ্যেই আপনাদের কাছে এসে হাজির হবে।
তিন মিনিট। আচ্ছা।
শোনেন, আমি আপনাকে একজন ডিবি পুলিশের নম্বর দিচ্ছি। উনি আসবেন আপনাদের কাছে। তাঁর নাম আবু নাসের ভুঁইয়া।
আচ্ছা দেন নম্বরটা। এসএমএস করে পাঠিয়ে দেন।
স্বাধীনের মোবাইল ফোনে এসএমএস চলে এসেছে।
তারা সবাই বসে আছে বারান্দায়। এই সময় দেখা গেল, কোট-প্যান্ট পরা রহস্যময় ভিক্ষুকটা বাইরের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকছে।
জাহিন আঁতকে উঠে শিশিরের হাত ধরে ফেলল। ওরে বাবারে, ওই…ওই…ভূত…লোকটা…
শিশির বলল, কোন ভূত?
জাহিন শিশিরের হাত আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ইংরেজি জানা ভূত।
স্বাধীনও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছে।
পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের আবু নাসের ভুঁইয়া আসছেন না কেন?
স্বাধীন তাঁর মোবাইল নম্বরে কল করল। রিং হচ্ছে।
হ্যালো…ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল।
স্বাধীন বলল, ডিবি অফিসার আবু নাসের ভুঁইয়া বলছেন?
হ্যাঁ, বলছি।
আমি স্বাধীন। আপনার নম্বর আমাকে দিয়েছেন ক্রাইম রিপোর্টার কামরুল হাসান। আপনার না বাগানবাড়িতে আসার কথা?
এই তো আমি ভেতরে…
তখন স্বাধীন বুঝতে পারল, ইংরেজি জানা এই ভূত অথবা ভিক্ষুক আসলে ডিবির লোক।
স্বাধীন এগিয়ে গেল, নাসের সাহেব, আসুন আসুন। আসুন।
স্বাধীন গলা উঁচু করে সবার সামনে ঘোষণা করল, জাহিন, চপল, শিশির, নাজনিন, তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ডিবির গোয়েন্দা আবু নাসের ভুঁইয়ার। আমার নাম স্বাধীন।
চপল বলল, ওর নাম চিকিৎ স্বাধীন সংক্ষেপে চিকা স্বাধীন।
শিশির বলল, চপল ভাই, আপনি সব সময় ইয়ার্কি করেন কেন? আমার দাদিকে ধরে নিয়ে গেছে আর আপনি কিনা…
চপল বলল, নাসের সাহেব, আপনি বসুন। এই চেয়ারটায় বসুন। শুনেছেন নিশ্চয়ই ঘটনা। এনার নাম শিশির। এর দাদি ওই দোলনাটায় বসেছিলেন। প্রায় আধঘণ্টা আগে তাঁকে একটা রোমশ প্রাণী, ভালুকের মতো, ধরে নিয়ে গেছে।
জাহিন বলল, ভালুক কি মানুষ খায়, ডিবি সাহেব?
ডিবি অফিসার বললেন, এই জঙ্গলে কোনো ভালুক নেই। কাজেই ভালুকে ধরেনি। ভালুকের পোশাক পরে কোনো মানুষ ধরে নিয়ে গেছে।
শিশির বলল, কিন্তু কেন?
ডিবি অফিসার বললেন, কেন, সেটা আমি পরে বলব। আগে ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করতে হবে।
চপল বলল, কাজটা খুব কঠিন হবে না। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কে সাহায্য করেছে, এটা আমি জানি। কোথায় রেখেছে, সেটা জানার জন্য আপনার এক্সপারটাইজ কাজে লাগবে।
সবাই একযোগে বলে উঠল, কে? কে সাহায্য করেছে?
চপল বলল, কাদের। এদিকে আসো।
শিশির, আপনি একটা কাজ করুন। আপনার দাদি যে পারফিউমটা ব্যবহার করেন, সেটা একটু ভেতর থেকে নিয়ে আসুন।
শিশির বলল, কেন?
আনুন না।
এবার চপল বলল, কাদেরের শার্টের কাছে সবাই যান। ওর গা থেকে কী ঘ্রাণ আসছে সবাই একটু শুঁকুন।
পাচ্ছেন কোনো ঘ্রাণ?
হ্যাঁ। পাওয়া যাচ্ছে। জাহিন বলল, হুঁ। যাচ্ছে।
স্বাধীন বলল, আমিও পাচ্ছি।
ডিবি অফিসার বললেন, হুঁ, আমিও পাচ্ছি বটে।
শিশির বলল, এবার আমি দাদির পারফিউম আনতে যাই।
জাহিন বলল, একা একা যেয়ো না। আমিও সঙ্গে যাই।
তারা দুজনে মিলে নিয়ে এল দাদির পারফিউমের শিশিটা। চপল সেটা স্প্রে করল নিজের কবজিতে।
সবাই বলে উঠল, এক্সাক্ট সেইম ঘ্রাণ। একই গন্ধ।
কাদের বলল, আজিব কথা। আমারে চোর বানাইতেছেন।
চপল বলল, কাদের মিয়া, তোমার বোতামের সঙ্গে দাদির চাদরের সুতা লেগে আছে। দেখো। এমনকি তাঁর চাদরের ওপরে যে চুমকি বসানো, তার দুইটা তোমার কাঁধে এখনো লেপ্টে আছে। জাহিন, দাদির চাদরটা যেটা উদ্ধার করা হলো, সেটা আন তো। ওই যে চেয়ারের পেছনে ঝোলানো আছে। ওইটা।
চপল কাদেরের কাঁধের কাছ থেকে দুটো চুমকি উদ্ধার করে ডিবি অফিসারের হাতে দিল। চাদরটা আনল জাহিন। দেখা গেল, ওই চাদরে একই চুমকি বসানো আছে।
ডিবি অফিসার আবু নাসের ভুঁইয়া যে এত ক্ষিপ্রগতির দক্ষ মানুষ, কে জানত। তিনি এক ঝটকায় কাদেরকে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন, আর তার হাত দুটো পেছনে বেঁধে ফেললেন।
কাদের আর্তনাদ করে উঠল।
ডিবি অফিসার বললেন, কই রেখেছিস ভদ্রমহিলাকে?
কাদের বলল, জঙ্গলের মধ্যে একটা চালাঘর আছে। সেইখানে।
সঙ্গে কে আছে?
জাহাঙ্গীর ভাই আছে।
জাহাঙ্গীর ভাইটা কে? চপল জিগ্যেস করল।
ডিবি অফিসার বললেন, সেটা না হয় একটু পরেই জানা যাবে। আগে চলুন, ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।
চপল, জাহিন, স্বাধীন আর ডিবি অফিসার চলল কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনারা দুজন ভদ্রমহিলা একলা একলা থাকবেন, ভয় করবেন না তো?
ডা. নাজনিন বললেন, প্রশ্নই আসে না। আমি একা একা চলাচল করছি না এখানে? কতবার এলাম-গেলাম। নারী হলেও আমরা ভয় পাই না, নিজেকে দুর্বলও মনে করি না।
চালাঘরটা বেশি দূরে নয়। তবে ঘন একটা জঙ্গলের আড়ালে। একটা ছোট টিলা পেরিয়ে যেতে হয়। রাতের অন্ধকারে সেই পথে হাঁটতে জাহিনের বুক ধড়ফড় করে কাঁপছে।
ডিবি অফিসার বললেন, জাহাঙ্গীর লোকটাকে আমিই সামলাব। আপনারা ভদ্রমহিলাকে দেখবেন। বলা তো যায় না, আরও কেউ থাকতে পারে। আবার অস্ত্রটস্ত্রও থাকতে পারে।
ডিবি অফিসার কোমরের নিচ থেকে একটা ছোট্ট রিভলবার বের করে দুহাতে ধরলেন। তারপর চালাঘরের বাঁশের বেড়ার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। চপল টর্চ জ্বালাল।
মাটিতে খড় বিছানো। সেখানেই বসে আছেন দাদি। তার মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। হাতও পেছন দিকে বাঁধা। এক পাশে একটা ভালুক।
ডিবি অফিসার বললেন, হ্যান্ডস আপ। জাহাঙ্গীর মিয়া, হাত ওপরে তোলো। একটু নড়াচড়া করবা তো স্ট্রেইট গুলি করে দেব।
ভালুকটা হাত ওপরে তুলে দাঁড়াল।
তার মুখটা খোলা।
একেবারে মানুষের মুখ।
ডিবি অফিসার বললেন, শীতটা আজকে একটু বেশিই পড়েছে, তাই না। ভালুকের পোশাক পরে থাকতে আরামই লাগছে। তাই না জাহাঙ্গীর?
ডিবি অফিসার জাহাঙ্গীরেরও হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেললেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ক্ষিপ্রতা দেখে কে বলবে, এই লোকই সেই লোক, যিনি চপলদের গাড়ির কাছে এসে ইংরেজিতে ভিক্ষা চাইতেন।
কাদের আর জাহাঙ্গীরকে সামনে রিভলবার দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তাঁরা পথ চলছেন। আর জাহিন, স্বাধীন, চপল দাদির হাত ধরে নিয়ে আসছে।
দাদি বলছেন, ধরতে হবে না। আমি হাঁটতে পারব।
তাঁরা ফিরে এলেন বাগানবাড়িতে।
ডাইনিং টেবিলে গোল হয়ে বসল সবাই।
এক পাশে মাটিতে বসে আছে হাত বাঁধা কাদের আর জাহাঙ্গীর।
চপল বলল, কাদের মিয়া, তুমি এই লোককে আগে থেকে চিনতে?
কাদের বলল, আমার বাপ-মায়ের কসম, কোনো দিন চিনতাম না।
তাহলে?
কাদের বলল, এইখানে আইসা আপনার বুদ্ধিতে আপনার জিনিসপাতি দিয়া ভয় দেখাই। জঙ্গলে যাই। আগুন জ্বালাই। সেই সব করতে গিয়া দেখি ওইখানে একটা চালাঘর। সেইখানে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। উনি আমারে জিগান, আপনে কী করেন?
আমি কই, মানষেরে ভয় দেখাই। আগুন জ্বালামু। ঢিল মারুম।
জাহাঙ্গীর ভাই কন, ক্যান, এই সব ক্যান করবেন?
আমি কই, চপল স্যারে মানষেরে ভয় দেখায়া মজা পায়।
উনি কন, আরে মিয়া ভয় দেখায়া মজা পায়া লাভ কী? আসেন। সত্যিকারের ভয় দেখাই। তাইলে আপনেরে টাকা দিমু।
চপল বলল, দিয়েছে টাকা?
কাদের বলে, খালি এক হাজার পাইছি। দাদিরে নিয়া যাইতে সাহায্য করলে দশ হাজার টাকা দিব কইছিল।
তাই তুমি দাদিকে কাঁধে তুলেছিলে?
হ। উনি তো ভালুকের ড্রেস পরা। হাঁটতে পারে না। হাতে ধরতে পারে না। অসুবিধা হয়।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা আমার একটা বড় রহস্য উন্মোচনে অনেক বড় হেল্প করলেন। এবার জাহাঙ্গীর বলো, তোমাকে কে রিক্রুট করেছে? মানে তোমাকে এই কাজ কে দিয়েছে?
জাহাঙ্গীর বলল, স্যার, আপনে তো জানেনই স্যার। মন্টু মিয়া জায়গাটা দখল করতে চান। মালিক লন্ডনে থাকে। বাগানবাড়ি চালায়। তো বাগানবাড়িতে ভূতের আসর আছে, জায়গাটা ভালো না বললে বাগানবাড়ি উইঠা যাইব। মালিক আর খোঁজ লইব না। তখন মন্টু মিয়া এইটা দখল করব। পেছনের জমিনটা তার। কিন্তু সেইটায় যাওনের রাস্তা নেই। এই জমিটা পাইলে তার জমির দাম কত বাইড়া যাইব ভাবেন।
তাই আমারে লাগায়া রাখছে। এই বাগানবাড়িতে গেস্ট আইলেই আমার কাম হইল ভয় দেখানো। তবে খুনখারাবি আমি কখনো করিনি। খালি ভয় দেখাইছি। আগুন জ্বালাইছি। ঢিল মারছি। তবে এই স্যারেরা দেখি আরও নানা রকমের ভয় দেখানোর বুদ্ধি জানে। এইবারে মন্টু সাবে কইল, ওই যে মুরব্বি মহিলা। এইটারে গায়েব করতে হইব। তাইলে লন্ডনে খবর হয়া যাইব। তাইলে জমিটা না বেইচা পারবই না।
এর মধ্যে বাইরে একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল।
মোবাইল ফোনে কথা বললেন ডিবি অফিসার। বললেন, লোকাল থানা থেকে পুলিশ এসেছে।
ডিবি অফিসার এগিয়ে গেলেন। পুলিশের তিনজন সদস্যকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। পুলিশ কাদের আর ভালুকের পোশাক পরা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গেল।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনারা ঘুমোতে যান। আর কোনো ভয়ের ঘটনা ঘটবে না আশা করি।
দাদি বললেন, মন্টু মিয়া যদি আবারও কাউকে পাঠায় রাতের বেলা?
ডিবি অফিসার বললেন, থানার লোক বাগানবাড়ি পাহারা দেবে। আপনারা চিন্তা করবেন না।
ডাক্তার নাজনিন বলল, আমি তাহলে এবার যাই।
স্বাধীন বলল, চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
রাতের বেলা জাহিনের ঘুম ভেঙে গেল।
শিশিরদের ঘর থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসছে বাঁচাও বাঁচাও বলে।
জাহিন ভয় পেয়ে গেল। ব্যাপার কী?
তার পাশে শুয়ে আছে চপল। চপলকে কি সে ডাকবে?
আবার আর্তনাদ। নারীকণ্ঠ বলেই চলেছে, বাঁচাও বাঁচাও।
শিশিরের কোনো বিপদ হয়েছে নিশ্চয়ই। জাহিন উঠে দৌড়ে গেল শিশিরদের ঘরের সামনে।
সত্যি ভেতর থেকে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ হলো।
শিশিরদের দরজার নিচ দিয়ে রক্ত এসে পড়ছে বারান্দায়।
জাহিন সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল শিশিরদের দরজায়।
ভেতর থেকে শিশিরের গলা, কে?
আমি জাহিন। শিশির কী হয়েছে?
কী হয়েছে মানে?
রক্ত কেন?
শিশির খিলখিল করে হাসছে। এই বাগানবাড়ি সত্যি একটা ভূতের বাড়ি। জাহিন এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে।
শিশির দরজা খুলল।
সে ভাঙা কাচের টুকরা কুড়াচ্ছে। বলল, আরে কোকের বোতলটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। দেখো, কোক পড়ে ঘরের কী অবস্থা।
বাঁচাও বাঁচাও বলে কে চিৎকার করছিল?—জাহিন ভয়-পাওয়া গলায় বলল।
শিশির সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে হাসছে।
ওই যে টেলিভিশনের নায়িকা। তাকে ভূতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এটা একটা হরর নাটক। বাংলা হরর তো। ভয়ের বদলে খালি হাসি পায়।
একটা ভূতের সাজে সজ্জিত লোক—তার কপালে চোখ আঁকা—একটা তরুণীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাঁধে করে। সে চেঁচাচ্ছে—বাঁচাও, বাঁচাও। জাহিন দেখতে পেল টিভি পর্দায়।
দাদি কই? জাহিন জিগ্যেস করল।
দাদি বাথরুমে। শাওয়ার নিচ্ছেন। তাঁকে ময়লা খড়ের গাদায় রাখা হয়েছিল। তিনি এক ঘণ্টার কম গোসল করবেনই না।
হঠাৎ শিশির চিৎকার করে উঠল ওরে বাবারে বলে।
লাফিয়ে এসে পড়ল জাহিনের ঘাড়ের ওপরে।
জাহিনও ভয় পেয়ে গেছে? কী?
ওই যে ওই যে…
জাহিন তাকিয়ে দেখল একটা তেলাপোকা।
সে হেসে ফেলল খিলখিল করে।
(সমাপ্ত)